কুরআন তিলাওয়াতের ফজিলত

কুরআন তিলাওয়াতের ফজিলত

কুরআন তিলাওয়াতের ফজিলত
আল্লাহ তাআলা বলেন :
إِنَّ الَّذِينَ يَتْلُونَ كِتَابَ اللَّهِ وَأَقَامُوا الصَّلاةَ وَأَنْفَقُوا مِمَّا رَزَقْنَاهُمْ سِرّاً وَعَلانِيَةً يَرْجُونَ تِجَارَةً لَنْ تَبُورَ، لِيُوَفِّيَهُمْ أُجُورَهُمْ وَيَزِيدَهُمْ مِنْ فَضْلِهِ إِنَّهُ غَفُورٌ شَكُورٌ (فاطر:২৯-৩০)
“যারা আল্লাহর কিতাব পাঠ করে, সালাত কায়েম করে, আমার দেয়া রিজিক থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে, তারাই আশা করতে পারে এমন ব্যবসার যা কখনো ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। কারণ আল্লাহ তাদের কর্মের পূর্ণ প্রতিদান দেবেন এবং নিজ অনুগ্রহে আরো অধিক দান করবেন। তিনি ক্ষমাশীল ও দয়াবান।”[১]
কুরআন তিলাওয়াত দু’প্রকার। যথা : ১. তিলাওয়াতে লাফজি বা আক্ষরিক পাঠ ২. তিলাওয়াতে হুকমি বা কার্যকর পাঠ।
প্রথম প্রকার তিলাওয়াত : তিলাওয়াতে লাফজি
তিলাওয়াতে লাফজি, অর্থাৎ কুরআনের অক্ষর ও শব্দ পাঠ করা। এ তিলাওয়াতের ফজিলত সম্পর্কে ওসমান রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
(خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ)
“তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ঐ ব্যক্তি যিনি কুরআন মজিদ শিক্ষা করে ও অন্যকে শিক্ষা দেয়।”[২]

 

উম্মুল মোমেনিন আয়েশা সিদ্দিকা রাদিআল্লাহু আনহার সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
)الْمَاهِرُ بِالْقُرْآنِ مَعَ السَّفَرَةِ الْكِرَامِ الْبَرَرَةِ وَالَّذِي يَقْرَأُ الْقُرْآنَ وَيَتَتَعْتَعُ فِيهِ وَهُوَ عَلَيْهِ شَاقٌّ لَهُ أَجْرَانِ- أحدهما على التلاوة والثاني على مشقتها على القاري(
“আল কুরআনে দক্ষ ও পণ্ডিত ব্যক্তি সম্মানিত পুণ্যবান ফেরেশতাদের সাথে থাকবে। যে ব্যক্তি কুরআন আটকে আটকে তিলাওয়াত করে এবং তা তার জন্য কষ্টকর হয়, তার জন্য দু’টি প্রতিদান রয়েছে। প্রথমটি, তিলাওয়াতের প্রতিদান, দ্বিতীয়টি কষ্টের প্রতিদান।”[৩]
আবু মুসা আশআরী রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
( مَثَلُ الْمُؤْمِنِ الَّذِي يَقْرَأُ الْقُرْآنَ كَمَثَلِ الْأُتْرُجَّةِ رِيحُهَا طَيِّبٌ وَطَعْمُهَا طَيِّبٌ وَمَثَلُ الْمُؤْمِنِ الَّذِي لَا يَقْرَأُ الْقُرْآنَ كَمَثَلِ التَّمْرَةِ لَا رِيحَ لَهَا وَطَعْمُهَا حُلْوٌ).
“যে মোমিন কুরআন তিলাওয়াত করে তার দৃষ্টান্ত কমলালেবুর মত, যা সুস্বাদু ও সুঘ্রাণযুক্ত। আর যে মোমিন কুরআন তিলাওয়াত করে না, তার দৃষ্টান্ত খেজুরের ন্যায় যার ঘ্রাণ নেই, কিন্তু মিষ্টি।[৪]
আবু উমামা বাহেলী রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি :
( اقْرَءُوا الْقُرْآنَ فَإِنَّهُ يَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ شَفِيعًا لِأَصْحَابِهِ).
“তোমরা কুরআন তিলাওয়াত কর, কারণ, কুরআন কেয়ামতের দিন তিলাওয়াতকারীর জন্য সুপারিশ করবে।”[৫]
উকবা বিন আমের রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
(أَفَلَا يَغْدُو أَحَدُكُمْ إِلَى الْمَسْجِدِ فَيَعْلَمُ أَوْ يَقْرَأُ آيَتَيْنِ مِنْ كِتَابِ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ خَيْرٌ لَهُ مِنْ نَاقَتَيْنِ وَثَلَاثٌ خَيْرٌ لَهُ مِنْ ثَلَاثٍ وَأَرْبَعٌ خَيْرٌ لَهُ مِنْ أَرْبَعٍ وَمِنْ أَعْدَادِهِنَّ مِنْ الْإِبِلِ).
“তোমাদের মধ্যে হতে যে ব্যক্তি সকালে মসজিদে দু’টি আয়াত পাঠ করে বা শিখে, তাকে দু’টি উট সদকা করার সওয়াব দেয়া হবে। এভাবে যত বেশি আয়াত তিলাওয়াত করবে, ততবেশি উট সদকা করার সওয়াব প্রদান করা হবে।”[৬]
আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
(مَا اجْتَمَعَ قَوْمٌ فِي بَيْتٍ مِنْ بُيُوتِ اللَّهِ يَتْلُونَ كِتَابَ اللَّهِ وَيَتَدَارَسُونَهُ بَيْنَهُمْ إِلَّا نَزَلَتْ عَلَيْهِمْ السَّكِينَةُ وَغَشِيَتْهُمْ الرَّحْمَةُ وَحَفَّتْهُمْ الْمَلَائِكَةُ وَذَكَرَهُمْ اللَّهُ فِيمَنْ عِنْدَهُ).
“যে কোন সম্প্রদায় আল্লাহর কোন ঘরে একত্রিত হয়ে কুরআন তিলাওয়াত করে এবং নিজদের মাঝে তা পঠন ও পাঠন করে, তাদের উপর শান্তি অবতীর্ণ হয়, আল্লাহর রহমত তাদের ঢেকে রাখে, ফেরেশতারা তাদের বেষ্টন করে রাখে এবং আল্লাহ তাআলা নিকটস্থ ফেরেশতাদের সঙ্গে তাদের ব্যাপারে আলোচনা করেন।”[৭]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন :
(تَعَاهَدُوا هَذَا الْقُرْآنَ فَوَالَّذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لَهُوَ أَشَدُّ تَفَلُّتًا مِنْ الْإِبِلِ فِي عُقُلِهَا).متفق عليه
“তোমরা কুরআনের যথাযথ যতœ নাও, তা মুখস্থ ও সংরক্ষণ কর। ঐ সত্তার শপথ! যার হাতে আমার জীবন, অবশ্যই উট তার রশি থেকে যেমন দ্রুত পালিয়ে যায়, তার চেয়েও আরো তীব্র বেগে পালানোর বস্তু এ কুরআন।”[৮]
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
(مَنْ قَرَأَ حَرْفًا مِنْ كِتَابِ اللَّهِ فَلَهُ بِهِ حَسَنَةٌ وَالْحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا لَا أَقُولُ الم حَرْفٌ وَلَكِنْ أَلِفٌ حَرْفٌ وَلَامٌ حَرْفٌ وَمِيمٌ حَرْفٌ). رواه الترمذي
“যে ব্যক্তি কুরআনের একটি হরফ পাঠ করে, তাকে একটি নেকি প্রদান করা হয়। প্রতিটি নেকি দশটি নেকির সমান। আমি বলি না যে, আলিফ-লাম-মীম একটি হরফ। বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ, মীম একটি হরফ।”[৯]
এ হলো কুরআন তিলাওয়াতের ফজিলত। অল্প আমলে অধিক সওয়াব তার জন্যই যে, আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সওয়াব আকাঙ্খা করে। সুতরাং যে কুরআনের ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করে, কুরআনের যথাযথ তদারকি করে না এবং তা দ্বারা উপকৃত না হয়, সে ক্ষতিগ্রস্ত। হে আল্লাহ! আমাদের হেফাজত করুন এবং নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত করার তওফিক দান করুন।
কুরআনের বিশেষ বিশেষ সুরার ফজিলত
সূরায়ে ফাতিহার ফজিলত :
সাহাবি আবু সাইদ ইবনে মুআল্লা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেছেন :
)لَأُعَلِّمَنَّكَ سُورَةً هِيَ أَعْظَمُ سُورَةٍ فِي الْقُرْآنِ قَالَ الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ هِيَ السَّبْعُ الْمَثَانِي وَالْقُرْآنُ الْعَظِيمُ الَّذِي أُوتِيتُهُ(.
“আমি তোমাকে কুরআনের একটি সুমহান সূরা শিখাব। সেটা হলো সূরা আল ফাতেহা। যার প্রথমাংশ আল-হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন। এটা সাবউল মাসানী বা সাতটি প্রশংসাযুক্ত আয়াত এবং এক মহান কুরআন যা আমাকে দান করা হয়েছে।”[১০]
সম্ভবত এ সব ফজিলতের কারণে সূরা ফাতেহার সালাতের মধ্যে পাঠ করা ওয়াজিব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
)لَا صَلَاةَ لِمَنْ لَمْ يَقْرَأْ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ(.متفق عليه
“যে ব্যক্তি সূরা ফাতেহা পাঠ করল না, তার সালাত শুদ্ধ নয়।”[১১]
আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
)مَنْ صَلَّى صَلَاةً لَمْ يَقْرَأْ فِيهَا بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ فَهِو خِدَاجٌ يقولها ثَلَاثًا(،فَقِيلَ لِأَبِي هُرَيْرَةَ إِنَّا نَكُونُ وَرَاءَ الْإِمَامِ فَقَالَ اقْرَأْ بِهَا فِي نَفْسِكَ) رواه مسلم
“যে ব্যক্তি সালাত আদায় করল, কিন্তু সূরা ফাতেহা পাঠ করল না, তার সালাত ত্র“টিপূর্ণ। তিনি কথাটি তিনবার বলেছেন।” তখন আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু কে জিজ্ঞাসা করা হল, আমরা তো ইমামের পিছনে থাকি ? তিনি বললেন, মনে মনে পড়বে।”[১২]
সূরা বাকারা ও সূরায়ে আলে-ইমরানের ফজিলত :
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
(اقْرَءُوا الزَّهْرَاوَيْنِ الْبَقَرَةَ وَسُورَةَ آلِ عِمْرَانَ فَإِنَّهُمَا تَأْتِيَانِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ كَأَنَّهُمَا غَمَامَتَانِ أَوْ كَأَنَّهُمَا غَيَايَتَانِ أَوْ كَأَنَّهُمَا فِرْقَانِ مِنْ طَيْرٍ صَوَافَّ تُحَاجَّانِ عَنْ أَصْحَابِهِمَا اقْرَءُوا سُورَةَ الْبَقَرَةِ فَإِنَّ أَخْذَهَا بَرَكَةٌ وَتَرْكَهَا حَسْرَةٌ وَلَا تَسْتَطِيعُهَا الْبَطَلَةُ قَالَ مُعَاوِيَةُ بَلَغَنِي أَنَّ الْبَطَلَةَ السَّحَرَةُ). رواه مسلم
“তোমরা দু’টি যাহরাবীন তথা পুষ্প পাঠ কর, যথা সূরা আল-বাকারা ও সূরা আলে ইমরান। কারণ এ দু’টি সূরা কেয়ামতের দিন মেঘমালার মত অথবা দু’দল পাখির ঝাঁকের ন্যায় সারিবদ্ধভাবে উড়বে। এরা উভয়ে পাঠকের পক্ষ গ্রহণ করবে। তোমরা সূরা বাকারা পাঠ কর। কারণ তার পাঠ করা বরকতের কারণ, তার পাঠ ত্যাগ করা হতাশা। অলসরা তা করতে পারবে না। মুআবিয়া বলেন, আমার শ্র“ত হয়েছে যে, বাতালার অর্থ জাদু।”[১৩]
আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
(أنَّ البيت الذي تقرأ فيه سورة البقرة لا يدخله الشيطان) رواه مسلم
“যে ঘরে সূরা আল-বাকারা তিলাওয়াত করা হয়, সে ঘরে শয়তান প্রবেশ করে না।”[১৪] শয়তান ঘরে প্রবেশ না করার কারণ হচ্ছে তাতে আয়াতুল কুরসী রয়েছে।
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত :
(أن جبرئيل قال وهو عِنْدَ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ هَذَا بَابٌ قد فتح من السماء ما فتح قط، قال : فَنَزَلَ مِنْهُ مَلَكٌ فأتى النبي صلى الله عليه وسلم أَبْشِرْ بِنُورَيْنِ أُوتِيتَهُمَا لَمْ يُؤْتَهُمَا نَبِيٌّ قَبْلَكَ فَاتِحَةُ الْكِتَابِ وَخَوَاتِيمُ سُورَةِ الْبَقَرَةِ لَنْ تَقْرَأَ بِحَرْفٍ مِنْهُمَا إِلَّا أُعْطِيتَهُ).
জিব্রীল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট থাকা অবস্থায় বলেন, দেখুন, এটা আকাশের একটি দরজা যা এই মাত্র খোলা হল। ইতিপূর্বে কখনো তা খোলা হয়নি। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর ঐ দরজা দিয়ে একজন ফেরেশতা রাসূলের নিকট এসে বললেন, আপনি দু’টি নূরের সুসংবাদ গ্রহণ করুন, যা আপনার পূর্বে কোন নবিকে দেয়া হয়নি। সেটা হল, সূরা ফাতেহা ও সূরা বাকারার শেষ আয়াতগুলোর সুসংবাদ। আপনি এ দু’টো তিলাওয়াত করে যে কোন হরফ দ্বারা যা চাইবেন, তা আপনাকে দেয়া হবে।”[১৫]
সূরা ইখলাসের ফজিলত :
আবু সাইদ খুদরি রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
(وَالَّذِيْ نَفْسِيْ بِيَدِهِ أنها تَعْدِلُ ثُلُثَ الْقُرْآنِ).
“সেই সত্তার শপথ! যার হাতে আমার জীবন, সূরা ইখলাস কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমান।”[১৬]
ফজিলতের ক্ষেত্রে সূরায়ে এখলাস কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমান। এ কথার অর্থ এই নয় যে, এ সূরা পুরো কুরআনের মোকাবিলায় যথেষ্ট। কারণ, কোন কিছু ফজিলতের দিক দিয়ে অন্য কোন বিষয়ের সমপর্যায়ের হলে এটা জরুরি নয় যে, এর ফলে অন্যটা না হলেও চলবে। সুতরাং কেউ সালাতে সূরা ফাতেহা ছেড়ে সূরা এখলাস তিনবার পড়লে তার সালাত শুদ্ধ হবে না। যেমন হাদিসে এসেছে, আবু আইউব আনসারি রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নীচের দোআর ফজিলতের ব্যাপারে বলেছেন :
(من قال لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ عَشَرَ مَرَّات كَانَ كَمَنْ أعتق أربعة نفس من ولد إسماعيل).
“যে ব্যক্তি এ সাক্ষ্য দেবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তিনি একক, তার কোন শরিক নেই, সকল রাজত্ব তার, তার জন্য সকল প্রশংসা। এ দুআ ১০ বার পড়ল, সে যেন ইসমাইল আলাইহিস সালামের সন্তানদের মধ্য থেকে চারজনকে মুক্ত করল।”[১৭]
এ দু-আর ফজিলত জানার পর কেউ যদি কাফ্ফারার ৪ জন কৃতদাস মুক্ত করার পরিবর্তে এ জিকির করে, তবে তা গ্রহনযোগ্য হবে না। কারণ, এখানে তাকে গোলাম-ই আজাদ করতে হবে।
সূরায়ে নাস ও সূরায়ে ফালাকের ফজিলত :
উকবা ইবনে আমের রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
(أَلَمْ تَرَ آيَاتٍ أُنْزِلَتْ اللَّيْلَةَ لَمْ يُرَ مِثْلُهُنَّ قَطُّ قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ وَقُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ النَّاسِ) رواه مسلم
“তুমি কি দেখনি আজ রাতে অবতীর্ণ হয়েছে এমন কিছু আয়াত, যেরূপ আয়াত আর লক্ষ্য করা যায়নি? তা হল সূরা ফালাক ও সূরা নাস।”[১৮]
ইমাম নাসায়ি রহ. বর্ণনা করেন :
 أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَمَرَ عقبة من أن يقرأ بهما ثم قال النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : مَا سَأَلَ سَائِلٌ بِمِثْلِهِمَا وَلَا اسْتَعَاذَ مُسْتَعِيذٌ بِمِثْلِهِمَا.
“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উকবা রাদিআল্লাহু আনহু কে নির্দেশ দিলেন, সূরা ফালাক ও সূরা নাস পাঠ করার জন্য। তারপর তিনি বললেন, এ দু’টি সুরার ন্যায় অন্য কোন জিনিসের মাধ্যমে কেউ প্রার্থনা করেনি, আর এ দু’টি সুরার ন্যায় অন্য কোন জিনিসের মাধ্যমে কেউ আশ্রয় প্রার্থনা করেনি।”
প্রত্যেক বছর রমজান মাসে জিব্রীল আলাইহিস সালাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে একবার পুরো কুরআন দাউর করতেন। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের বছর দু’ বার পুরো কুরআন দাউর করেন। যাতে কুরআন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হৃদয়ে স্থায়ী ও স্থিরভাবে বদ্ধ মূল হয়ে যায়। উলামায়ে কেরাম, সালফে সালেহিন রমজান ও রমজান ছাড়া অন্য মাসে কুরআন বেশি বেশি তিলাওয়াত করতেন। ইমাম যুহরি রাদিআল্লাহু আনহু রমজান মাস আগমন করলে বলতেন, এটা কুরআন তিলাওয়াতের মাস এবং খাদ্য দানের মাস। রমজান মাসে ইমাম মালেক রাদিআল্লাহু আনহু হাদিস পাঠ ও এলমি আসর পরিত্যাগ করতেন এবং পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতে আত্মনিয়োগ করতেন।
কাতাদা রাদিআল্লাহু আনহু সপ্তাহে একবার কুরআন খতম করতেন। রমজানে প্রতি ৩ দিনে একবার খতম করতেন এবং রমজানের শেষ দশকে প্রতি দিন এক খতম কুরআন তিলাওয়াত করতেন।
প্রিয় পাঠক! আপনাদের উপর আল্লাহ রহম করুন, আপনারা এ সকল নেককারদের অনুসরণ করুন। মহা পরাক্রমশালী ও ক্ষমাশীল আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য দিন রাতের সদ্ব্যবহার করুন। কারণ, আয়ু খুব দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে।
হে আল্লাহ! আমাদের এমন তিলাওয়াতের তওফিক দান করুন, যাতে আপনার সন্তুষ্টি অর্জনে সক্ষম হই। কুরআনকে আমাদের জন্য সুপথ ও সহজ-সরল নির্ভেজাল পথ প্রদর্শক রূপে বানিয়ে দিন। কুরআনের রশ্মি ও আলোর মাধ্যমে আমাদেরকে বক্রতা, পথভ্রষ্টতা ও অন্ধকারের অতল গহ্বর থেকে উজ্জ্বল জ্যোতিময় আলোর সন্ধান দিন। এ কুরআনের মাধ্যমে আমাদের সম্মান বৃদ্ধি করুন। আমাদেরকে গোপনীয় দোষ-ত্র“টি ও অপরের দোষ চর্চা করা থেকে বিরত রাখুন এবং আমাদের যাবতীয় গোপনীয় গুনাহ গোপন রাখুন। হে পরম করুণাময় ও দয়ালু প্রভু! আমাদের পিতা-মাতা ও শান্তি প্রিয় সকল মুসলমানকে ক্ষমা করুন। দরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক আমাদের নবি মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর ও তার পরিবারসহ সকল সাহাবি ও অনুসরণকারীদের উপর।
দ্বিতীয় প্রকার তিলাওয়াত :  তিলাওয়াতে হুকমি
আল্লাহর আদেশ মান্য করা ও নিষিদ্ধ বিষয় পরিহার করার মাধ্যমে কুরআন অনুযায়ী জীবন-যাপন করাই হচ্ছে তিলাওয়াতে হুকমি। অর্থাৎ কুরআনের সকল সংবাদ বিশ্বাস, কুরআনে বর্ণিত সকল নিষিদ্ধ বস্তু বর্জন ও সকল নির্দেশ পালন করার মাধ্যমে কুরআনের হুকুম আহকাম মেনে চলা। আর কুরআন নাজিলের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে এ প্রকার তিলাওয়াত।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
(كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَكٌ لِيَدَّبَّرُوا آيَاتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ أُولُو الْأَلْبَابِ) (صّ:২৯)
‘আমি এমন বরকতপূর্ণ কিতাব তোমার নিকট নাজিল করেছি, যাতে করে তারা এর আয়াত নিয়ে গবেষণা করতে পারে এবং যাতে করে জ্ঞানবানরা উপদেশ গ্রহণ করতে পারে।”[১৯]
আমাদের পূর্ব পুরুষ সালফে সালেহিনগণ এ আয়াতের নির্দেশনা অনুযায়ী কুরআন অধ্যয়ন করতেন। তারা এর প্রতি গভীর বিশ্বাস ও সুদৃঢ় আকিদা পোষণ করে এর হুকুম আহকামগুলো বাস্তবায়ন করতেন।
আবু আব্দুর রহমান আস্সুলামা রহ. বলেন :
حدثنا الذين كانوا يقرؤوننا القرآن، عثمان بن عفان وعبد الله بن مسعود، وغيرهما، إنهم كانوا إذا تعلموا من النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عشر آيات لم يتعلموها ومافيها من العلم والعمل قالوا فتعلمنا القرآن والعلم والعمل جميعا-
“যারা আমাদেরকে কুরআন পড়ে শোনাতেন, তারা আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন, অর্থাৎ ওসমান বিন আফফান, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ ও অন্যান্য সাহাবাবৃন্দ। যখন তারা নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে কুরআনের দশটি আয়াত শিখতেন, তখন তারা এ দশটি আয়াতই ভালভাবে আত্মস্থ করতেন এবং এতে যা এলম ও আমল আছে তা বাস্তবায়ন করা ছাড়া সামনে অগ্রসর হতেন না। তারা বলেন, এভাবেই আমরা কুরআন, এলম ও আমল সব এক সঙ্গে শিখেছি।”
এ প্রকার তিলাওয়াতের মাধ্যমেই মানুষের ভাগ্য নির্ণীত হয়, কে ভাগ্যবান আর কে হতভাগা।
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন :
(فَإِمَّا يَأْتِيَنَّكُمْ مِنِّي هُدىً فَمَنِ اتَّبَعَ هُدَايَ فَلا يَضِلُّ وَلا يَشْقَى- وَمَنْ أَعْرَضَ عَنْ ذِكْرِي فَإِنَّ لَهُ مَعِيشَةً ضَنْكاً وَنَحْشُرُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعْمَى- قَالَ رَبِّ لِمَ حَشَرْتَنِي أَعْمَى وَقَدْ كُنْتُ بَصِيراً- قَالَ كَذَلِكَ أَتَتْكَ آيَاتُنَا فَنَسِيتَهَا وَكَذَلِكَ الْيَوْمَ تُنْسَى- وَكَذَلِكَ نَجْزِي مَنْ أَسْرَفَ وَلَمْ يُؤْمِنْ بِآياتِ رَبِّهِ وَلَعَذَابُ الْآخِرَةِ أَشَدُّ وَأَبْقَى) (طـه:১২৩-১২৭)
“এরপর যদি আমার পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে হেদায়েত আসে, তখন যে আমার হেদায়েতকে অনুসরণ করবে, সে পথভ্রষ্ট হবে না এবং কষ্টে পতিত হবে না। আর যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তার জীবিকা সংকীর্ণ হবে এবং আমি তাকে কিয়ামতের দিন উত্থিত করব অন্ধ করে। সে তখন বলবে, হে আমার রব, কেন তুমি আমাকে অন্ধ করে উত্থিত করলে? আমিতো ছিলাম চক্ষুষ্মান। আল্লাহ বলবেন, এমনিভাবে এসেছিল তোমার নিকট আমার আয়াতগুলো। এরপর তুমি সেগুলো ভুলে গিয়েছিলে। তেমনিভাবে আজ তুমি বিস্মৃত হবে। এমনিভাবে আমি তাকে দেব প্রতিফল, যে সীমালঙ্ঘন করেছে এবং বিশ্বাস করেনি তার রবের আয়াতসমূহের প্রতি। আর পরকালের শাস্তি হবে কঠোরতর এবং অনেক স্থায়ী।”[২০]
“আল্লাহ তাআলা এ আয়াতসমূহে রাসুলদের নিকট পাঠানো হেদায়েত অনুসরণকারীদের কল্যাণের কথা স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন। আমাদের সামনে মহাগ্রন্থ আল-কুরআন হল সবচেয়ে বড় হেদায়েত। এখানে তিনি হেদায়েত বিমুখদের শাস্তির কথাও বর্ণনা করেছেন। যারা হেদায়েত অনুসরণ করবে, তারা পথভ্রষ্ট হবে না, দুঃখ কষ্টে পতিত হবে না, তাদের থেকে পথ বিচ্যুতি ও অকল্যাণ দূর করে দেয়া হবে। তাদের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে নেয়ামত ও কল্যাণ অব্যাহত থাকবে। আর যারা হেদায়েত বিমুখ, যারা হেদায়েত অনুযায়ী আমল করেনি বরং অহংকার করেছে, তাদের জন্য রয়েছে শাস্তি। তারা দুনিয়া ও আখেরাতে পথ ভ্রষ্টতায় থাকবে, তাদের থেকে দুঃখ কষ্ট লাগব করা হবে না। তাদের জীবন হবে খুব-ই সংকীর্ণ। তারা দুনিয়াতে দুশ্চিন্তা ও আত্মিক অস্থিরতার মধ্যে থাকবে। কারণ, তাদের কোন সহিহ বিশ্বাস বা নেক আমল ছিল না। আল্লাহ তাআলা তাদের ব্যাপারে-ই বলেছেন।
(أُولَئِكَ كَالْأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ أُولَئِكَ هُمُ الْغَافِلُونَ) (الأعراف:১৭৯)
“এরা চতুষ্পদ জন্তুর ন্যায় বরং এরা তাদের চেয়েও আরো অধম ও নিকৃষ্ট, এরাই হলো গাফেল।”[২১]
হেদায়েত প্রত্যাখ্যানকারী এ গ্র“পের কবর হবে সংকীর্ণ, যার দরুন তাদের দেহের পাঁজরগুলো বাঁকা হয়ে যাবে। অবশেষে কিয়ামতের দিন অন্ধ হয়ে উত্থিত হবে, তারা কিছুই দেখতে পাবে না।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
(وَنَحْشُرُهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَلَى وُجُوهِهِمْ عُمْياً وَبُكْماً وَصُمّاً مَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ كُلَّمَا خَبَتْ زِدْنَاهُمْ سَعِيراً) (الاسراء:৯৭)
“আমি কিয়ামতের দিন তাদেরকে সমবেত করব তাদের মুখে ভর দিয়ে চলা অবস্থায়, অন্ধ অবস্থায়, মূক অবস্থায়, বধির অবস্থায়। তাদের আবাসস্থল জাহান্নাম। যখন জাহান্নামের আগুন নির্বাপিত হওয়ার উপক্রম হবে আমি তখন তাদের জন্য অগ্নি আরও বাড়িয়ে দেব।”[২২]
তারা দুনিয়ায় সত্য পথ অবলম্বন করেনি, সত্য কথাও শ্রবণ করেনি। তারা ছিল অন্ধ-বধির। আল্লাহ তাআলা তাদের কথার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন :
(وَقَالُوا قُلُوبُنَا فِي أَكِنَّةٍ مِمَّا تَدْعُونَا إِلَيْهِ وَفِي آذَانِنَا وَقْرٌ وَمِنْ بَيْنِنَا وَبَيْنِكَ حِجَابٌ) (فصلت:৫)
“তারা বলে, আপনি যে বিষয়ের দিকে আমাদেরকে ডাকছেন, সে বিষয়ে আমাদের অন্তর আবরণে আবৃত, আর আমাদের কর্ণে আছে বধিরতা এবং আমাদের ও আপনার মাঝখানে আছে অন্তরায়।”[২৩]
তারা দুনিয়াতে যেরূপ কর্ম করেছে আল্লাহ তাআলা আখেরাতে তাদেরকে সেরূপ প্রতিদান দেবেন। এরা যেরূপ আল্লাহর শরিয়তকে ধ্বংস ও বিনষ্ট করেছে, তদ্রুপ আল্লাহও তাদের ধ্বংস ও বিনষ্ট করবেন।
আল্লাহ তাআলা এসব কাফিরের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন :
(قَالَ رَبِّ لِمَ حَشَرْتَنِي أَعْمَى وَقَدْ كُنْتُ بَصِيرا. قَالَ كَذَلِكَ أَتَتْكَ آيَاتُنَا فَنَسِيتَهَا وَكَذَلِكَ الْيَوْمَ تُنْسَى) (طـه:১২৬)
“সে বলবে, হে আমার রব! তুমি কেন আমাকে অন্ধ করে উত্থিত করলে অথচ আমি তো ছিলাম চক্ষুষ্মান? তখন আল্লাহ বলবেন, এমনিভাবে তোমার নিকট আমার আয়াতসমূহ এসেছিল এরপর তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে, তাই আজ তোমাকেও সেরূপ ভুলে যাওয়া হবে, বিস্মৃত হবে তুমি।”[২৪]
এটা তাদের কর্মের পরিপূর্ণ প্রতিদান হিসেবে দেয়া হবে। তাদের জন্য আরো রয়েছে জাহান্নামের ফুটন্ত পানি ও পুঁজ।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
(وَمَنْ جَاءَ بِالسَّيِّئَةِ فَلا يُجْزَى الَّذِينَ عَمِلُوا السَّيِّئَاتِ إِلَّا مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ) (القصص:৮৪)
“আর যে ব্যক্তি মন্দ কর্ম নিয়ে আসবে, তবে যারা মন্দ কর্ম করেছে, তাদের সেরূপই প্রতিদান দেয়া হবে।”[২৫]
সহিহ বুখারিতে আছে :
وعن سمرة بن جندب ঃ { ঊৎৎড়ৎ! ইড়ড়শসধৎশ হড়ঃ ফবভরহবফ.أن النبي ৎ كان إذا صلى صلاة – وفي لفظ: صلاة الغداة – أقبل علينا بوجهه فقال: ” من رأى منكم الليلة رؤية؟ ” قال: فإن رأى أحد قَصَّها. فيقول: ” ما شاء الله “. فسألنا يوما فقال: ” هل رأى أحد منكم رؤية؟ ” قلنا: لا. قال: ” لكني رأيت الليلة رجلين أتياني ” (فساق الحديث وفيه:) ” فانطلقنا حتى أتينا على رجل مضطجع، وإذا آخر قائم عليه بصخرة وإذا هو يهوي بالصخرة لرأسه فيثلغ رأسه فيَتَدَهْدَه الحجر هاهنا فيتبع الحجر فيأخذه فلا يرجع إلى الرجل حتى يصبح رأسُه كما كان، ثم يعود عليه فيفعل به مثلما فعل به المرة الأولى، فقلت: سبحان الله ! ما هذا؟ فقالا لي: انطلِق ” (فذكر الحديث وفيه:) ” أما الرجل الذي أتيت عليه يُثْلغ رأسُه بالحجر فهو الرجل يأخذ القرآن فيرفضه وينام عن الصلاة المكتوبة }
“আল্লাহর নবি ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোন নামায পড়তেন, অন্য রেওয়ায়েতে এসেছে, যখন ফজরের নামায পড়তেন তখন তিনি আমাদের দিকে মুখ করে অগ্রসর হয়ে বলতেন, তোমাদের মধ্যে কেউ কি আজ রাতে কোন স্বপ্ন দেখছে? হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবি বলেন, কেউ স্বপ্ন দেখলে সে তা বর্ণনা করত। তিনি স্বপ্ন শ্রবন করে বলতেন, মা-শাআল্লাহ। অর্থাৎ আল্লাহ যা চেয়েছেন তা-ই হয়েছে। অভ্যাস মোতাবেক একদিন তিনি আমাদের জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের কেউ কি আজ রাতে কোন স্বপ্ন দেখেছে? আমরা বললাম না, তিনি বললেন, কিন্তু আমি দেখেছি। দুজন লোক রাতে আমার নিকট এসেছে, (হাদীসের ভাষা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন) আমরা চললাম, অতঃপর এমন জায়গায় আসলাম যেখানে একজন লোক শুয়ে আছে, অপরজন তার মাথার কাছে পাথর নিয়ে দাঁড়ানো। মাথার ওপর পাথর নিক্ষেপ করতেই, মাথা পাথরের আঘাতে টুকরো টুকরো হয়ে যায়, যখন সে পাথর উঠিয়ে আনতে যায়, তার মাথা পুর্বের ন্যায় হয়ে যায়। অতঃপর তার সাথে পুনরায় আগের মত ব্যবহার করা হয়। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন : আমি এতে আশ্চর্য হয়ে বললাম, সুব্হানাল্লাহ! এটা কি? তারা দুজন আমাকে বলল, সামনে চলুন। এ হাদিসের শেষে আছে, যে লোকটার মাথা খণ্ডবিখণ্ড করা হচ্ছিল, সে হচ্ছে ঐ ব্যক্তি যে কুরআনকে গ্রহণ করে, দূরে নিক্ষেপ করেছে, ফরজ নামাজ আদায় না করে ঘুমিয়ে থেকেছে।”
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, আল্লাহর নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজের ভাষণে সকলকে লক্ষ্য করে বলেছেন :
(إن الشيطان قد يئس أن يعبد في أرضكم ولكن رضي أن يطاع فيما سوى ذلك مما تحاقرون من أعمالكم فاحذروا، إني تركت فيكم ما إن تمسكتم به فلن تضلوا أبدا كتاب الله وسنة نبيه) رواه الحاكم وقال صحيح الإسناد
“এ ভূমিতে শয়তানের দাসত্ব করা হবে, এমন আশা শয়তান করে না। তবে তা ছাড়া অন্য ব্যাপারে যে তোমরা তার আনুগত্য করবে, তাতেই সে সন্তুষ্ট। যেমন তোমরা তোমাদের আমলকে তুচ্ছ জ্ঞান করবে, খবরদার! এমনটি কর না। আমি তোমাদের মাঝে এমন জিনিস রেখে যাচ্ছি, যা আকড়ে ধরলে তোমরা গোমরাহ হবে না। অর্থাৎ আল্লাহর কিতাব ও তার রাসূলের সুন্নত।”[২৬]
সহীহ মুসলিম শরীফে আবূ মালেক আশয়ারী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন :
(القرآن حجة لك او عليك)
“কুরআন তোমার পক্ষের কিংবা বিপক্ষের দলীল।”[২৭]
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন :
(القرآن شافع مشفع فمن جعله أمامه قاده إلى الجنة ومن جعله خلف ظهره ساقه إلى النار).
“কুরআন সুপারিশকারী এবং তার সুপারিশ গ্রহণযোগ্য। সুতরাং যে ব্যক্তি কুরআনকে সামনে রেখে তার অনুসরণ করবে, কুরআন তাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি একে নিজ পশ্চাতে রেখে দিবে, কুরআন তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে।”
প্রিয় পাঠক! যাদের বিরুদ্ধে কুরআন মামলা করবে, তাদের জন্য কুরআন কিভাবে সুপারিশ করবে, তারা কিভাবে কুরআনের সুপারিশ আশা করতে পারে?
হে আল্লাহর বান্দাগণ! এটা আল্লাহর কালাম, আল-কুরআন। যে কুরআন পাহাড়ের পর নাজিল হলে, পাহাড়ও ভয়ে ফেঁটে পড়ত। তা সত্বেও তোমাদের কর্ণসমূহ কুরআন শ্রবন করছে না! তোমাদের চক্ষুসমূহ অশ্র“ ঝরাচ্ছে না! ভীত সন্ত্রস্ত হচ্ছে না তোমাদের হৃদয়সমূহ! আফসোস! কিভাবে তোমরা জাহান্নম থেকে নির্ভয় হয়ে গেলে! অথচ কুরআন হচ্ছে জাহান্নাম থেকে নাজাতের একমাত্র পথ, তার সুপারিশ নিশ্চিত কবুল করা হবে। তবুও কেন তোমাদের এ পশ্চাৎগামীতা, কুরআন বিমূখীতা।
আমাদের অন্তরগুলো তাকওয়া শূন্য, জনমানব হীন পরিত্যক্ত এক মরুভূমি, যার চারদিকে ছড়িয়ে আছে গোনার অন্ধকার। আমাদের অন্তরগুলো পাথরের মত কিংবা তার চেয়ে আরো কঠিন। কত রমযান আমাদের ওপর দিয়ে অতিক্রম করেছে অথচ আমাদের অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। কোন যুবক বিরত থাকেনি তার যৌবনের ফানুস উড়ানো থেকে, কোন বৃদ্ধ সরে আসেনি তার প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে। আমরা কবে হব তাদের মত, যারা কুরআনের ডাকে সাড়া দেয়, কুরআনের তিলাওয়াত শুনে যাদের হৃদয় প্রকম্পিত হয়, কেঁপে উঠে। তারা সত্যকে চিনতে পেরেছে, তারাই কল্যাণের পথ এখতিয়ার করেছে। তাদের ওপরই রয়েছে আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ ও দয়া।
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন :
(ينبغي لقارئ القرآن أن يعرف بليله إذا الناس ينامون، وبنهاره إذا الناس يفطرون، وببكائه إذا الناس يضحكون، وبورعه إذا الناس يخلطون وبصمته إذا الناس يخوضون وبخشوعه إذا الناس يختالون وبحزنه إذا الناس يفرحون).
“কুরআন পাঠকের রাতের মর্যাদা বুঝা উচিত, যখন মানুষ ঘুমিয়ে থাকে; দিনের গুরুত্ব বুঝা উচিত, যখন মানুষ রোযা বিহীন থাকে; ক্রন্দনের মহত্ব বুঝা উচিত, যখন মানুষ হাসে; তাকওয়ার গুরুত্ব বুঝা উচিত, যখন মানুষ গুনাহে লিপ্ত হয়; নিরবতার ফজিলত বুঝা উচিত, যখন মানুষ অযথা গল্পে-আড্ডায় মগ্ন থাকে; বিনয়ের কদর করা উচিত, যখন মানুষ অহংকার করে এবং চিন্তার গুরুত্ব উপলব্দি করা উচিত, যখন মানুষ উল্লাসে মেতে থাকে।”
প্রিয় পাঠক! সময় ফুরিয়ে যাবার পূর্বে কুরআন মুখস্থ করে নাও, এর বিধানের সীমালঙ্ঘন করা থেকে বিরত থাক। মনে রেখ, এ কুরআন একদিন তোমার পক্ষ নিবে কিংবা বিপক্ষে অবতীর্ণ হবে।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
(وَيَوْمَ يَعَضُّ الظَّالِمُ عَلَى يَدَيْهِ يَقُولُ يَا لَيْتَنِي اتَّخَذْتُ مَعَ الرَّسُولِ سَبِيلاً. يَا وَيْلَتَى لَيْتَنِي لَمْ أَتَّخِذْ فُلاناً خَلِيلاً. لَقَدْ أَضَلَّنِي عَنِ الذِّكْرِ بَعْدَ إِذْ جَاءَنِي وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِلْإِنْسَانِ خَذُولاً. وَقَالَ الرَّسُولُ يَا رَبِّ إِنَّ قَوْمِي اتَّخَذُوا هَذَا الْقُرْآنَ مَهْجُوراً. وَكَذَلِكَ جَعَلْنَا لِكُلِّ نَبِيٍّ عَدُوّاً مِنَ الْمُجْرِمِينَ وَكَفَى بِرَبِّكَ هَادِياً وَنَصِيراً) (الفرقان:২৭-৩১)
“আর সেদিন যালিম নিজের হাত দু’টো কামড়িয়ে বলবে, ‘হায়, আমি রাসূলের সাথে কোন পথ অবলম্বন করতাম! হায়, আমার দুর্ভোগ, আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম। অবশ্যই সে তো আমাকে উপদেশবাণী থেকে বিভ্রান্ত করেছিল, আমার কাছে তা আসার পর।’ আর শয়তান তো মানুষের জন্য চরম প্রতারক। আর রাসূল বলবে, ‘হে আমার রব, নিশ্চয় আমার কওম এ কুরআনকে পরিত্যাজ্য গণ্য করেছে। আর এভাবেই আমি প্রত্যেক নবীর জন্য অপরাধীদের মধ্য থেকে শত্র“ বানিয়েছি। আর পথ পথপ্রদর্শক ও সাহায্যকারী হিসেবে তোমার রবই যথেষ্ট।”[২৮]
কুরআন তিলাওয়াতের আদব প্রসঙ্গ
প্রিয় পাঠক! এ কুরআন যা আপনাদের নিকট আছে, আর যা আপনারা তিলাওয়াত করছেন, শুনছেন, মুখস্থ করছেন ও লিপিবদ্ধ করছেন, তা বিশ্ব জাহানের রব মহান আল্লাহ তাআলার কালাম। যিনি আপনাদের রব। পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সবার ইলাহ। এ কুরআন আল্লাহ তাআলার সুদৃঢ় রজ্জু, তার সরল সঠিক পথ ও দিক নির্দেশনা এবং বরকতময় উপদেশ বাণী ও স্পষ্ট নূর। এ কুরাআন দ্বারাই আল্লাহ তাআলা নিজ শান মোতাবেক কালাম করেছেন। তিনি জিব্রাইল এর মাধ্যমে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর এ কুরআন নাজিল করেছেন। উদ্দেশ্য এর মাধ্যমে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুষ্পষ্ট আরবী ভাষায় মানব জাতিকে সতর্ক করবেন।
আমাদের অন্তরে এ কুরআনের মহত্ব, গুরুত্ব ও মর্যাদা বর্ধিত করার জন্য মহান আল্লাহ তাআলা কতিপয় বিশেষণে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছেন এ কুরআনকে।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
(شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدىً لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ) (البقرة:১৮৫)
“রমযান এমন মাস যাতে নাজিল হয়েছে মহাগ্রন্থ আল-কুরআন। যা বিশ্ব মানবতার জন্য হেদায়েতও সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা এবং হক ও বাতিলের মধ্যকার পার্থক্য বিধান কারী।”[২৯]
আল্লাহ তাআলা বলেন :
(ذَلِكَ نَتْلُوهُ عَلَيْكَ مِنَ الْآياتِ وَالذِّكْرِ الْحَكِيمِ) (آل عمران:৫৮)
“এটা এমন গ্রন্থ যার আয়াতসমূহ ও প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশ আপনার নিকট তিলাওয়াত করি।”[৩০]
আল্লাহ তাআলা বলেন :
(يَا أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءَكُمْ بُرْهَانٌ مِنْ رَبِّكُمْ وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكُمْ نُوراً مُبِيناً) (النساء:১৭৪)
“হে মানব জাতি! অবশ্যই তোমাদের নিকট তোমাদের রবের পক্ষ থেকে দলীল এসেছে এবং তোমাদের নিকট সুস্পষ্ট নূর আমি নাজিল করেছি।”[৩১]
আল্লাহ তাআলা বলেন :
(قَدْ جَاءَكُمْ مِنَ اللَّهِ نُورٌ وَكِتَابٌ مُبِينٌ. يَهْدِي بِهِ اللَّهُ مَنِ اتَّبَعَ رِضْوَانَهُ سُبُلَ السَّلامِ) (المائدة:১৫-১৬)
“অবশ্যই তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে আলো ও সুস্পষ্ট গ্রন্থ এসেছে। এর মাধ্যমে আল্লাহ তাদেরকে শান্তির পথ দেখান যারা তাঁর সন্তুষ্টির অনুসরণ করে।”[৩২]
আল্লাহ তাআলা বলেন :
)وَمَا كَانَ هَذَا الْقُرْآنُ أَنْ يُفْتَرَى مِنْ دُونِ اللَّهِ وَلَكِنْ تَصْدِيقَ الَّذِي بَيْنَ يَدَيْهِ وَتَفْصِيلَ الْكِتَابِ لا رَيْبَ فِيهِ مِنْ رَبِّ الْعَالَمِينَ) (يونس:৩৭)
“আর এ কুরআন তো এমন নয় যে, আল্লাহ ছাড়া কেউ তা রচনা করতে পারবে; বরং এটি যা তার সামনে রয়েছে, তার সত্যায়ন এবং কিতাবের বিস্তারিত ব্যাখ্যা, যাতে কোন সন্দেহ নেই, যা সৃষ্টিকুলের রবের পক্ষ থেকে।”[৩৩]
আল্লাহ তাআলা বলেন :
(يَا أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءَتْكُمْ مَوْعِظَةٌ مِنْ رَبِّكُمْ وَشِفَاءٌ لِمَا فِي الصُّدُورِ وَهُدىً وَرَحْمَةٌ لِلْمُؤْمِنِينَ) (يونس:৫৭)
“হে লোক সকল! তোমাদের নিকট উপদেশ বাণী এসেছে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে, এবং তা অন্তরের রোগের নিরাময়, হেদায়েতও মুমিনদের জন্য রহমত।”[৩৪]
আল্লাহ তাআলা বলেন :
(كِتَابٌ أُحْكِمَتْ آيَاتُهُ ثُمَّ فُصِّلَتْ مِنْ لَدُنْ حَكِيمٍ خَبِيرٍ) (هود:১)
“এটা এমন কিতাব, যার আয়াতসমূহ সুদৃঢ় ও সুপ্রতিষ্টিত। অতঃপর সবিস্তারে বর্ণিত এক মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময় সত্বার পক্ষ থেকে।”[৩৫]
আল্লাহ তাআলা বলেন :
(إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ) (الحجر:৯)
“নিশ্চয় আমি উপদেশ বাণী তথা কুরআন নাজিল করেছি এবং নিঃসন্দেহে এর হেফাজতকারী আমি নিজেই।”[৩৬]
আল্লাহ তাআলা বলেন :
(وَلَقَدْ آتَيْنَاكَ سَبْعاً مِنَ الْمَثَانِي وَالْقُرْآنَ الْعَظِيمَ. لا تَمُدَّنَّ عَيْنَيْكَ إِلَى مَا مَتَّعْنَا بِهِ أَزْوَاجاً مِنْهُمْ وَلا تَحْزَنْ عَلَيْهِمْ وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِلْمُؤْمِنِينَ) (الحجر:৮৭-৮৮)
“আমি তোমাকে দিয়েছি পুনঃপুনঃ পঠিত সাতটি আয়াত ও মহা কুরআন। আমি তাদের কিছু শ্রেণীকে যে ভোগ উপকরণ দিয়েছি, তার প্রতি তুমি দু’চোখ প্রসারিত করো না। আর তাদের জন্য দুঃখিত হয়ো না। এবং মুমনিদের জন্য তোমার বাহু অবনত কর।”[৩৭]
আল্লাহ তাআলা বলেন :
(وَنَزَّلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ تِبْيَاناً لِكُلِّ شَيْءٍ وَهُدىً وَرَحْمَةً وَبُشْرَى لِلْمُسْلِمِينَ) (النحل:৮৯)
“আমি তোমার নিকট কিতাবটি নাজিল করেছি। এটি এমন যে তা সবকিছুর সুস্পষ্ট বর্ণনা, আর এটা হেদায়াত, রহমত ও মুসলিমদের জন্য সুসংবাদ স্বরূপ।”[৩৮]
আল্লাহ তাআলা বলেন :
(إِنَّ هَذَا الْقُرْآنَ يَهْدِي لِلَّتِي هِيَ أَقْوَمُ وَيُبَشِّرُ الْمُؤْمِنِينَ الَّذِينَ يَعْمَلُونَ الصَّالِحَاتِ أَنَّ لَهُمْ أَجْراً كَبِيراً. وَأَنَّ الَّذِينَ لا يُؤْمِنُونَ بِالْآخِرَةِ أَعْتَدْنَا لَهُمْ عَذَاباً أَلِيماً) (الاسراء:৯-১০)
“নিশ্চয় এ কুরআন, যা যথার্থ ও সঠিক পথের দিকেই পথ নির্দেশ করে এবং ঈমানদারদের সুসংবাদ প্রদান করে, যারা নেক কাজ করে, নিঃসন্দেহে তাদের জন্য মহা প্রতিদান রয়েছে। আর যারা আখেরাতের প্রতি ঈমান আনে না তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির ব্যবস্থা করেছি।”[৩৯]
আল্লাহ তাআলা বলেন :
(وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْآنِ مَا هُوَ شِفَاءٌ وَرَحْمَةٌ لِلْمُؤْمِنِينَ وَلا يَزِيدُ الظَّالِمِينَ إِلَّا خَسَاراً) (الاسراء:৮২)
“আমি নাজিল করেছি এমন কুরআন যা রোগের নিরাময় এবং মুমিনদের জন্য রহমত স্বরূপ। আর এটা জালিমদের ক্ষতি ছাড়া অন্য কিছুই বৃদ্ধি করে না।”[৪০]
আল্লাহ তাআলা বলেন :
(قُلْ لَئِنِ اجْتَمَعَتِ الْأِنْسُ وَالْجِنُّ عَلَى أَنْ يَأْتُوا بِمِثْلِ هَذَا الْقُرْآنِ لا يَأْتُونَ بِمِثْلِهِ وَلَوْ كَانَ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ ظَهِيراً) (الاسراء:৮৮)
“বলে, যদি মানব ও জ্বিন জাতি সবাই মিলে একত্রিত হয় যে, তারা এ কুরআন অনুরূপ কিছু আনয়ন করবে, তারা এ কুরআনের অনুরূপ কিছুই আনয়ন করতে পারবে না, যদিও তারা একে অপরের সাহায্যকারী হয়।”[৪১]
আল্লাহ তাআলা বলেন :
(مَا أَنْزَلْنَا عَلَيْكَ الْقُرْآنَ لِتَشْقَى. إِلَّا تَذْكِرَةً لِمَنْ يَخْشَى. تَنْزِيلاً مِمَّنْ خَلَقَ الْأَرْضَ وَالسَّمَاوَاتِ الْعُلَى) (طـه:২-৪)
“আমি তোমার প্রতি আল কুরআন এ জন্য নাজিল করিনি যে, তুমি দুর্ভোগ পোহাবে। বরং যে ভয় করে তার জন্য উপদেশ স্বরূপ। যিনি যমীন ও সুউচ্চ আসমানসমূহ সৃষ্টি করেছেন তাঁর নিকট থেকে অবতীর্ণ।”[৪২]
আল্লাহ তাআলা বলেন :
(تَبَارَكَ الَّذِي نَزَّلَ الْفُرْقَانَ عَلَى عَبْدِهِ لِيَكُونَ لِلْعَالَمِينَ نَذِيراً)  (الفرقان:১)
“বরকতময় সেই সত্বা যিনি হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্য বিধানকারী কুরআন তাঁর বান্দার প্রতি নাজিল করেছেন, যাতে তিনি বিশ্ববাসীর জন্য সতর্ককারী হতে পারে।”[৪৩]
আল্লাহ তাআলা বলেন :
(وَإِنَّهُ لَتَنْزِيلُ رَبِّ الْعَالَمِينَ. نَزَلَ بِهِ الرُّوحُ الْأَمِينُ. عَلَى قَلْبِكَ لِتَكُونَ مِنَ الْمُنْذِرِينَ. بِلِسَانٍ عَرَبِيٍّ مُبِينٍ. وَإِنَّهُ لَفِي زُبُرِ الْأَوَّلِينَ. أَوَلَمْ يَكُنْ لَهُمْ آيَةً أَنْ يَعْلَمَهُ عُلَمَاءُ بَنِي إِسْرائيلَ) (الشعراء:১৯২-১৯৭)
“নিশ্চয় এ কুরআন তো বিশ্ব জাহানের রবের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ। বিশ্বস্ত ফেরেস্তা একে নিয়ে অবতরণ করেছে, আপনার অন্তরে, যাতে আপনি ভীতি প্রদর্শনকারীদের অন্যতম হোন, সুষ্পষ্ট আরবী ভাষায়। নিশ্চয় এর উল্লেখ আছে পূর্ববর্তী কিতাবসমূহে। তাদের জন্যে এটা কি নিদর্শন নয় যে, বনী-ইসরাইলের আলেমগণ এটা অবগত আছেন।”[৪৪]
আল্লাহ তাআলা বলেন :
(وَمَا تَنَزَّلَتْ بِهِ الشَّيَاطِينُ. وَمَا يَنْبَغِي لَهُمْ وَمَا يَسْتَطِيعُونَ) (الشعراء:২১১)
“আর শয়তানরা এ কুরআন নিয়ে অবতরণ করে না। আর তাদের জন্য উচিতও নয় এবং তারা পারবেও না।”[৪৫]
আল্লাহ তাআলা বলেন :
(بَلْ هُوَ آيَاتٌ بَيِّنَاتٌ فِي صُدُورِ الَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ وَمَا يَجْحَدُ بِآياتِنَا إِلَّا الظَّالِمُونَ) (العنكبوت:৪৯)
“বরং এ কুরআন কতিপয় নিদর্শন ও যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে এদের হৃদয়ে কতিপয় সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা।”[৪৬]
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন :
(إِنْ هُوَ إِلَّا ذِكْرٌ وَقُرْآنٌ مُبِينٌ. لِيُنْذِرَ مَنْ كَانَ حَيّاً وَيَحِقَّ الْقَوْلُ عَلَى الْكَافِرِينَ) (يّـس:৭৯-৮০)
“এটা তো কেবল এক উপদেশবাণী ও প্রকাশ্য কুরআন। যাতে তিনি সতর্ক করতে পারেন জীবিতকে এবং যাতে কাফেরদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়।”[৪৭]
আল্লাহ তাআলা বলেন :
(كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَكٌ لِيَدَّبَّرُوا آيَاتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ أُولُو الْأَلْبَابِ) (صّ:২৯)
“তোমার নিকট অবতীর্ণ করেছি এক বরকতপূর্ণ কিতাব যাতে তারা এর আয়াতসমূহ নিয়ে চিন্তা গবেষণা করতে পারে, আর জ্ঞানীরা যেন উপদেশ গ্রহণ করতে পারে।”[৪৮]
আল্লাহ তাআলা বলেন :
(قُلْ هُوَ نَبَأٌ عَظِيمٌ) (صّ:৬৭)
“বল, তা মহা সংবাদ।”[৪৯]
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন :
(اللَّهُ نَزَّلَ أَحْسَنَ الْحَدِيثِ كِتَاباً مُتَشَابِهاً مَثَانِيَ تَقْشَعِرُّ مِنْهُ جُلُودُ الَّذِينَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ ثُمَّ تَلِينُ جُلُودُهُمْ وَقُلُوبُهُمْ إِلَى ذِكْرِ اللَّهِ ذَلِكَ هُدَى اللَّهِ يَهْدِي بِهِ مَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُضْلِلِ اللَّهُ فَمَا لَهُ مِنْ هَادٍ) (الزمر:২৩)
“আল্লাহ উত্তম বাণী নাজিল করেছেন, যা সাদৃশ্যপূর্ণ একটি কিতাব, যা বার বার পঠিত হয়। যারা তাদের রবকে ভয় করে, তাদের গা এতে শিহরিত হয়, অতঃপর তাদের দেহ ও মন আল্লাহর স্মরণে বিনম্র হয়ে যায়। এটা আল্লাহর হেদায়াত, তিনি যাকে চান এর দ্বারা হেদায়েত করেন। আর আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন, তার জন্য কোন হেদায়েতকারী নেই।”[৫০]
আল্লাহ তাআলা বলেন :
(إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا بِالذِّكْرِ لَمَّا جَاءَهُمْ وَإِنَّهُ لَكِتَابٌ عَزِيزٌ. لا يَأْتِيهِ الْبَاطِلُ مِنْ بَيْنِ يَدَيْهِ وَلا مِنْ خَلْفِهِ تَنْزِيلٌ مِنْ حَكِيمٍ حَمِيدٍ) (فصلت:৪১-৪২)
“নিশ্চয়ই কুরআন তাদের নিকট আগমন করার পর যারা তা অস্বীকার করে (তাদের পরিণাম ভোগ করতে হবে) এটা অবশ্যই মহিমাময় গ্রন্থ। বাতিল এতে অনুপ্রবেশ করে না, না সামনে থেকে, না পিছন থেকে, এটা প্রশংসিত, প্রজ্ঞাময় রবের পক্ষ থেকে নাজিল হয়েছে।”[৫১]
আল্লাহ তাআলা বলেন :
(وَكَذَلِكَ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ رُوحاً مِنْ أَمْرِنَا مَا كُنْتَ تَدْرِي مَا الْكِتَابُ وَلا الْأِيمَانُ وَلَكِنْ جَعَلْنَاهُ نُوراً نَهْدِي بِهِ مَنْ نَشَاءُ مِنْ عِبَادِنَا) (الشورى:৫২)
“এমনিভাবে আমি তোমার কাছে আমার নির্দেশ থেকে রূহ-কে ওহী যোগে প্রেরণ করেছি। তুমি জানতে না কিতাব কী আর ঈমান কী? কিন্তু আমি একে আলো বানিয়েছি, যার মাধ্যমে আমি আমার বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা হেদায়েত দান করি। আর নিশ্চয় তুমি সরল পথের দিক নির্দেশনা দাও।”[৫২]
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেন :
(وَإِنَّهُ فِي أُمِّ الْكِتَابِ لَدَيْنَا لَعَلِيٌّ حَكِيمٌ) (الزخرف:৪)
“নিশ্চয় এ কুরআন আমার কাছে উম্মুল কিতাবে সুউচ্চ মর্যাদা, প্রজ্ঞাপূর্ণ।”[৫৩]
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেন :
(هَذَا بَصَائِرُ لِلنَّاسِ وَهُدىً وَرَحْمَةٌ لِقَوْمٍ يُوقِنُونَ) (الجاثـية:২০)
“এটা মানুষের জন্য আলোকবর্তিকা এবং নিশ্চিত বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য হেদায়াত ও রহমত।”[৫৪]
আল্লাহ তাআলা বলেন :
(فَلا أُقْسِمُ بِمَوَاقِعِ النُّجُومِ. وَإِنَّهُ لَقَسَمٌ لَوْ تَعْلَمُونَ عَظِيمٌ. إِنَّهُ لَقُرْآنٌ كَرِيمٌ. فِي كِتَابٍ مَكْنُونٍ. لا يَمَسُّهُ إِلَّا الْمُطَهَّرُونَ. تَنْزِيلٌ مِنْ رَبِّ الْعَالَمِينَ) (الواقعة:৭৫-৮০)
“অতএব আমি তারকারাজির অস্তাচলের শপথ করছি। নিশ্চয় এটা মহা শপথ যদি তোমরা জানতে। নিশ্চয় এটা সম্মানিত কুরআন, যা আছে এক গুপ্ত গ্রন্থে, লওহে মাহফুযে। যারা পাক-পবিত্র তারা ব্যতীত অন্য কেউ একে স্পর্শ করে না। এটা সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ।”[৫৫]
আল্লাহ তাআলা বলেন :
(لَوْ أَنْزَلْنَا هَذَا الْقُرْآنَ عَلَى جَبَلٍ لَرَأَيْتَهُ خَاشِعاً مُتَصَدِّعاً مِنْ خَشْيَةِ اللَّهِ وَتِلْكَ الْأَمْثَالُ نَضْرِبُهَا لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ) (الحشر:২১)
“যদি আমি নাজিল করতাম এ কুরআনকে পাহাড়ের ওপর তাহলে অবশ্যই তুমি দেখতে পেতে পাহাড় বিনীত হয়ে আল্লাহর ভয়ে বিদীর্ণ হয়ে গেছে। আমি এসব দৃষ্টান্ত মানুষের জন্য উপস্থাপন করি। যাতে তারা চিন্তা করতে পারে।”[৫৬]
আল্লাহ তাআলা জ্বিন জাতির কথার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন :
(إِنَّا سَمِعْنَا قُرْآناً عَجَباً.يَهْدِي إِلَى الرُّشْدِ فَآمَنَّا بِهِ) (الجـن:১-২)
“নিশ্চয় আমরা বিস্ময়কর এক কুরআন শুনেছি যা হেদায়াতের পথে পরিচালিত করে। সুতরাং আমরা এর প্রতি ঈমান আনলাম।”[৫৭]
আল্লাহ তাআলা বলেন :
(بَلْ هُوَ قُرْآنٌ مَجِيدٌ. فِي لَوْحٍ مَحْفُوظٍ) (البروج:২১-২২)
“বরং এটা সম্মানিত কুরআন। যা লওহে মাহফুজে রয়েছে।”[৫৮]
এ সব বৈশিষ্ট যা কুরআনের ব্যাপারে উল্লেখ করলাম আর যা উল্লেখ করিনি, সব গুলোই এ কুরআনের মহত্ব ও বিশালত্বের জ্বলন্ত দলীল এবং কুরআনকে স্বতঃস্ফুর্তভাবে ইজ্জত ও সম্মান প্রদর্শন করার প্রতি আহ্বান জানায়। বিরত থাকতে বলে এর সাথে সব ধরনের আদব বর্হিভূত আচরণ, উপহাস, ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা থেকে।
কুরআন তিলাওয়াতের আদব
১. কুরআন তিলাওয়াতের শুরুতে নিয়ত খালেস করা।
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেন :
(فَادْعُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ) (غافر:১৪)
“সুতরাং তোমরা আল্লাহকে একনিষ্ঠভাবে ইখলাসের সাথে ডাক।”[৫৯]
আল্লাহ তাআলা বলেন :
(فَاعْبُدِ اللَّهَ مُخْلِصاً لَهُ الدِّينَ) (الزمر:২)
“সুতরাং তুমি একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত কর।”[৬০]
আল্লাহ তাআলা বলেন :
(وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاءَ) (البينة:৫)
“তাদের এ জন্যই নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তারা আল্লাহর ইবাদত করবে খাঁটি মনে, এখলাসের সাথে।”[৬১]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করছেন :
(اقْرَءُوا الْقُرْآنَ وَابْتَغُوا بِهِ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَ قَوْمٌ يُقِيمُونَهُ إِقَامَةَ الْقِدْحِ يَتَعَجَّلُونَهُ وَلَا يَتَأَجَّلُونَهُ) رواه أحمد
“তোমরা কুরআন তিলাওয়াত কর এবং এ তিলাওয়াত দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা কর। সে দলের আবির্ভাবের পূর্বে যারা কুরআনকে তীরের ন্যায় স্থাপন করবে। কুরআন দ্রুত পড়বে, ধীর স্থীরভাবে পড়বে না।”[৬২]
২. একনিষ্ঠ মন নিয়ে কুরআন তিলাওয়াত করা। যা পড়া হয় তা নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করা, তার অর্থ অনুধাবনের চেষ্টা করা, বিনয়ীভাব গ্রহণ করা এবং নিজকে এমনভাবে হাজির করা যেন আল্লাহর সাথে সংলাপ হচ্ছে। বাস্তবেও কুরআন তিলাওয়াত আল্লাহর সাথে সংলাপ, যেহেতু কুরআন আল্লাহ তাআলারই বাণী।
৩. পবিত্র অবস্থায় কোরআন তিলাওয়াত করা। অপবিত্র ব্যক্তি বা যার উপর গোসল ফরজ, সে পবিত্রতা অর্জন ব্যতীত কুরআন পাঠ করবে না। সম্ভব হলে পানি দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করবে অন্যথায় তায়াম্মুম দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করবে। তবে গোসল ব্যতীত আল্লাহর যিকির করতে পারবে এবং কুরআনে আছে এমন দোয়া পাঠ করতে পারবে, কিন্তু কুরআন পাঠের নিয়তে নয়। যেমন সে বলতে পারে :
(لا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِينَ) (الانبياء:৮৭)
“আল্লাহ তুমি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তোমার পবিত্রতা ঘোষণা করছি। নিশ্চয় আমি জালিমদের অর্ন্তভুক্ত।”
কিংবা পড়তে পারবে :
)رَبَّنَا لا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ رَحْمَةً إِنَّكَ أَنْتَ الْوَهَّابُ) (آل عمران:৮)
“হে আমাদের রব! তুমি আমাদেরকে হেদায়েত দান করার পর আমাদের অন্তরসমূহকে বক্র করে দিওনা। আর তুমি তোমার পক্ষ থেকে দান কর আমাদের রহমত। নিশ্চয় তুমি অফুরন্ত দানশীল।”
৪. ময়লা আবর্জনা আছে এমন স্থানে কুরআন তিলওয়াত না করা। যেখানে গান-বাদ্য বা শোরগোল হচ্ছে এমন জায়গায় কুরআন তিলাওয়াত না করা। এ সব জায়গায় কুরআন তিলাওয়াত করা, কুরআনের সাথে অসম্মান ও অপমান জনিত ব্যবহার করার শামিল। প্রশ্রাব কিংবা পায়খানার জন্য তৈরীকৃত স্থানে কুরআন তিলাওয়াত করা জায়েজ নেই।
৫. কুরআন তিলাওয়াতের শুরুতে বলা :
اعوذ بالله من الشيطان الرجيم
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন :
(فَإِذَا قَرَأْتَ الْقُرْآنَ فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ) (النحل:৯৮)
“যখন তুমি কুরআন পাঠ কর, তখন বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাও।”[৬৩]
যাতে তিলাওয়াতের সর্বক্ষেত্রে শয়তানের বাধা থেকে নিরাপদ থাকা যায়। সুরার মাঝখান থেকে তিলাওয়াত করলে বিসমিল্লাহ পড়ার প্রয়োজন নেই, শুধু আউজুবিল্লাহ পড়লেই চলবে, সুরার শুরু থেকে পাঠ করলে বিসমিল্লাহ পড়বে। অবশ্য সূরা তাওবার শুরুতে বিসমিল্লাহ পড়বে না। কারণ এ সুরার প্রথমে বিসমিল্লাহ নেই।
৬. তিলাওয়াতের কণ্ঠ সুন্দর করা এবং সুর দিয়ে তিলাওয়াত করা। সহীহ বুখারী ও মুসলিমে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাআলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কুরআনের ক্ষেত্রে আওয়াজ সুন্দর করার জন্য যতটুকু তাগিদ দিয়েছেন, অন্য কোন বিষয়ে তত তাগিদ দেননি।
সহিহ বুখারি ও মুসলিম শরীফে জুবাইর ইবনে মুতইম রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন :
سَمِعْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقْرَأُ فِي الْمَغْرِبِ بِالطُّورِ فَمَا سَمِعْتُ أَحَدًا أَحْسَنَ أو قراءة منه
“আমি মাগরিব নামাযে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সূরায়ে তুর পড়তে শুনেছি। এত সুন্দর কণ্ঠ ও কেরাত আমি আর কারো থেকে শুনিনি।”
৭. কারো কষ্টের কারণ হলে উচ্চ স্বরে কুরআন পাঠ করবে না। যেমন নামাযী, ঘুমন্ত বা অসুস্থ ব্যক্তির নিকট। একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কতক সাহাবাদের দেখলেন, তারা নামাযে উচ্চ স্বরে কেরাতে পড়ছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের বললেন :
(إِنَّ الْمُصَلِّيَ يُنَاجِي رَبَّهُ تَبَارَكَ فَلْيَنْظُرْ بِمَا يُنَاجِيهِ وَلَا يَجْهَرْ بَعْضُكُمْ عَلَى بَعْضٍ فِيْ القرآن) رواه مالك في المطأ قال أبي عبد البر : وهو حديث صحيح
“নামাযী ব্যক্তি নিজ রব আল্লাহর সাথে মোনাজাত করে, অতএব তার লক্ষ্য রাখা উচিত, কিভাবে সে প্রার্থনা করবে। কুরআন পাঠের সময় একজনের আওয়াজ অপর জনের আওয়াজের চেয়ে যেন উচ্চ না হয়।”[৬৪]
৮. কুরআন তারতীল বা ধীর স্থীরভাবে সুন্দর করে তিলাওয়াত করা। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন :
(وَرَتِّلِ الْقُرْآنَ تَرْتِيلاً) (المزمل:৪)
“তুমি কুরআনকে তারতীলের সাথে তিলাওয়াত কর।”[৬৫]
কুরআন তিলাওয়াত করবে ধীর স্থীরভাবে। কারণ ধীর স্থীরভাবে তিলাওয়াত করলে শব্দ ও অক্ষর সঠিকভাবে উচ্চারণ করা যায় এবং কুরআনের অর্থ অনুধাবন করার জন্যও সহায়ক হয়। সহিহ বুখারিতে এসেছে :
عن أنس بن مالك رضي الله عنه أنه سُئِلَ أَنَسٌ عَنْ قِرَاءَةِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ كَانَتْ مَدًّا ثُمَّ قَرَأَ بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ يَمُدُّ بِبِسْمِ اللَّهِ وَيَمُدُّ بِالرَّحْمَنِ وَيَمُدُّ بِالرَّحِيمِ- رواه البخاري
“আনাস বিন মালেক থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আনাস রাদিআল্লাহু আনহুকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কেরাতের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। তিনি বললেন, তার কেরাত ছিল দীর্ঘ আকারের, টেনে টেনে তিনি তিলাওয়াত করতেন। এরপর তিনি রাসূলের তিলাওয়াত নকল করার জন্য পড়লেন :
بسم الله الرحمن الرحيم
তিনি ‘আল্লাহ, রাহমান ও রাহীম শব্দে মদ করলেন।
উম্মে সালমা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কেরাত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন :
كان يقطع قراءته آية آية- بسم الله الرحمن الرحيم -الحمد لله رب العالمين -الرحمن الرحيم-مالك يوم الدين- رواه أحمد وأبو داود والترمذي
“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটা একটা আয়াত, আলাদা আলাদা পড়তেন। যেমন, তিনি পড়তেন:
بسم الله الرحمن الرحيم
তারপর পড়তেন :
(الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ)
তারপর পড়তেন :
(الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ)
তারপর পড়তেন :
(مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ)
এভাবে আলাদা আলাদা তিলাওয়াত করতেন।[৬৬]
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন :
وقال ابن مسعود رضي الله عنه لا تنشروه نثر الرمل ولا تهذوه هذا الشعر قفوا عند عجائبه وحركوا به القلوب ولا يكن هم أحدكم آخر السورة.
“তোমরা বালু ছিটানোর মত ও কবিতার আবৃতি দ্রুত কুরআন তিলাওয়াত কর না। কুরআনের বিস্ময়কর বিষয়ের নিকট থামো এবং কুরআন দ্বারা তোমাদের অন্তরসমূহকে আন্দোলিত কর। তোমাদের কারো সূরা শেষ করা-ই যেন তিলাওয়াতের মূল উদ্দেশ্য না হয়।”
৯. কুরআন তিলাওয়াতের সময় সেজদার আয়াত আসলে সেজদা করা, তবে ওজু থাকা জরুরি।
সিজদার নিয়ম : প্রথমে আল্লাহু আকবার বলে সিজাদায় যাবে এবং সিজদায় গিয়ে বলবে :   سبحان ربى الاعلى অতঃপর দোয়া করবে। সিজদা থেকে তাকবীর বলে মাথা উঠাবে, তবে নামাজের ন্যায় সালাম ফিরাবে না।
বর্ণিত আছে, আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু সিজদায় মাথা উঠাতে ও নামাতে তাকবির বলতেন। তিনি বলতেন, “রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযে এরূপ করেছেন।”[৬৭]
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন :
رأيت النبي صلى الله عليه وسلم يكبر في كل رفع وخفض وقيام وقعود-رواه أحمدوالنسائيوالترمذي وصححه
“আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রত্যেকবার মাথা উঠাতে ও নামাতে, বসতে ও দাঁড়াতে তাকবির বলতে দেখেছি।”[৬৮]
এ হাদিস নামাযের সিজদা ও নামাযের বাইরে কুরআন তিলাওয়াতের সিজদা উভয়কেই শামিল করে। এ হলো কুরআন তিলাওয়াতের কতিপয় আদব। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে সর্ব ক্ষেত্রে তার বিধান ও সন্তুষ্টি মোতাবেক আমল করার তওফিক দান করুন। আমীন
সমাপ্ত
[১] ফাতির : ২৯-৩০
[২] বুখারি
[৩] বুখারি ও মুসলিম
[৪] মুসলিম
[৫] মুসলিম
[৬] মুসলিম
[৭] মুসলিম
[৮] বুখারি ও মুসলিম
[৯] তিরমিজি
[১০] বুখারি
[১১] বুখারি ও মুসলিম
[১২] মুসলিম
[১৩] মুসলিম
[১৪] মুসলিম
[১৫] মুসলিম
[১৬] বুখারী
[১৭] বুখারী ও মুসলিম
[১৮] মুসলিম
[১৯] সূরা সাদ : ২৯
[২০] তাহা : ১২৩-১২৭
[২১] আরাফ : ১৭৯
[২২] সূরা আল  ইসরা : ৯৭
[২৩] সূরা ফুসসিলাত : ৫
[২৪] সূরা তা-হা : ১২৬
[২৫] সূরা কাসাস : ৮৪
[২৬] হাকেম : তিনি বলেনÑ হাদীসটির সনদ সহীহ।
[২৭] মুসলিম : ২২৩
[২৮] সূরা আল-ফুরকান : ২৭-৩১
[২৯] সূরা  আল বাকারা, আয়াত : ১৮৫
[৩০] সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ৫৮
[৩১] সূরা নিসা, আয়াত : ১৭৪
[৩২] সূরা মায়েদা, আয়াত : ১৫-১৬
[৩৩] সূরা ইউনূস, আয়াত : ৩৭
[৩৪] সূরা ইউনূস, আয়াত : ৫৭
[৩৫] সূরা হুদ, আয়াত : ১
[৩৬] সূরা আল হিজর, আয়াত : ৯
[৩৭] সূরা আল হিজর, আয়াত : ৮৭-৮৮
[৩৮] সূরা নাহল, আয়াত : ৮৯
[৩৯] সূরা আল ইসরা, আয়াত : ৯-১০
[৪০] সূরা আল ইসরা, আয়াত : ৮২
[৪১] সূরা আল ইসরা, আয়াত : ৮৮
[৪২] সূরা ত্বা-হা, আয়াত : ২-৪
[৪৩] সূরা আল ফুরকান, আয়াত : ১
[৪৪] সূরা শুআরা, আয়াত : ১৯২-১৯৭
[৪৫] সূরা শুআরা, আয়াত : ২১১
[৪৬] সূরা আনকাবুত, আয়াত : ৪৯
[৪৭] সূরা ইয়াসীন, আয়াত : ৭৯-৮০
[৪৮] সূরা সাদ, আয়াত : ২৯
[৪৯] সূরা সাদ : ৬৭
[৫০] সূরা যুমার আয়াত : ২৩
[৫১] সূরা হামীম আস-সাজদা, আয়াত : ৪১-৪২
[৫২] সূরা আশ শূরা, আয়াত : ৫২
[৫৩] সূরা যুখরুফ, আয়াত : ৪
[৫৪] সূরা জাসিয়া, আয়াত : ২০
[৫৫] সূরা ওয়াকিয়া, আয়াত : ৭৫-৮০
[৫৬] সূরা হাশর, আয়াত : ২১
[৫৭] সূরা জিন, আয়াত : ১-২
[৫৮] সূরা বুরুজ, আয়াত : ২১-২২
[৫৯] সূরা গাফের, আয়াত : ১৪
[৬০] সূরা যুমার, আয়াত : ২
[৬১] সূরা বাইয়েনা, আয়াত : ৫
[৬২] আহমাদ
[৬৩] সূরা নাহল, আয়াত : ৯৮
[৬৪] মুআত্তা মালেক ইমাম ইবনে আব্দুল বার একে সহীহ হাদীস বলেছেন।
[৬৫] সূরা মুযযাম্মিল : আয়াত ৬৫
[৬৬] আহমদ , আবু দাউদ, তিরমিজী
[৬৭] মুসলিম
[৬৮] আহমদ, নাসারী, তিরমিযী, তিরমিযী একে সহীহ বলেছেন।
_________________________________________________________________________________
 লেখক: মুহাম্মদ বিন সালেহ আল-উসাইমীন
تأليف : محمد بن صالح العثيمين – رحمه الله
অনুবাদ: সানাউল্লাহ বিন নজির আহমদ
ترجمة : ثناء الله بن نذير أحمد
 সম্পাদনা : আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান
مراجعة : عبد الله شهيد عبد الرحمن
 সূত্র : ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব
المكتب التعاوني للدعوة وتوعية الجاليات بالربوة بمدينة الرياض
এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

Blog at WordPress.com.