কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে তাকলীদ

কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে তাকলীদ –
ভূমিকা :
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান, যা আল্লাহ
তা‘আলা বিশ্বমানবতার জন্য দান করেছেন। আর
তাকে বাস্তবায়ন করার জন্য যুগে যুগে নবী-
রাসূলগণকে প্রেরণ করেছেন এবং ইসলামের
যাবতীয় বিধি-বিধান অহী মারফত
জানিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং অহী-র বিধানই
একমাত্র অভ্রান্ত জীবনবিধান। বর্তমান বিশ্বের
প্রায় দেড়শত কোটি মুসলমান বসবাস করে।
তারা বিশ্বের অন্যান্য জাতির সাথে তাল
মিলিয়ে সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক
অঙ্গনে এগিয়ে চলেছে। পিছিয়ে পড়েছে শুধু
আল্লাহর বিধান পালনে। ফলে মুসলমান
হওয়া সত্ত্বেও অনেকের আচরণ অমুসলিম-
কাফেরদের সাথে অনেকটাই সাদৃশ্যপূর্ণ। আবার
যারা ইসলামের বিধান বাস্তবায়নে নিয়োজিত,
তারা অধিকাংশই শতধাবিভক্ত। বিভিন্ন
তরীকা ও মাযহাবের
বেড়াজালে নিজেদেরকে আবদ্ধ রেখে,
পরস্পরে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হয়ে বিচ্ছিন্ন
জীবন-যাপন করছে। নির্দিষ্ট কোন মাযহাবের
অন্ধানুসরণের কারণে আল্লাহ প্রদত্ত অহী-র
বিধানকে বাদ দিয়ে মাযহাবী গোঁড়ামিকেই
প্রাধান্য দিচ্ছে। তারা নিজেদেরকে মাযহাবের
প্রকৃত অনুসারী দাবী করলেও
মূলতঃ তারা অনুসরণীয় ইমামগণের
কথাকে উপেক্ষা করে তাঁদের অবমাননা করছে।
কারণ প্রত্যেক ইমামই তাঁদের তাক্বলীদ
করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। এ নিবন্ধে এ
বিষয়ে আলোচনা করার প্রয়াস পাব
ইনশাআল্লাহ।
তাকলীদের শাব্দিক অর্থ :
‘তাকলীদ’ ( ﺍﻟﺘﻘﻠﻴﺪ ) শব্দটি ‘ক্বালাদাতুন’ ( ﻗﻼﺩﺓ) হ’তে গৃহীত।
যার অর্থ কণ্ঠহার বা রশি। যেমন
বলা হয়, ﻗَﻠَّﺪَ ﺍﻟْﺒَﻌِﻴْﺮَ ‘সে উটের গলায় রশি বেঁধেছে’।
সেখান থেকে ‘মুক্বাল্লিদ’ ( ﻣﻘﻠﺪ ) ,
যিনি কারো আনুগত্যের রশি নিজের গলায়
বেঁধে নিয়েছেন।
তাকলীদের পারিভাষিক অর্থ :
তাক্বলীদ হ’ল শারঈ বিষয়ে কোন মুজতাহিদ
বা শরী‘আত গবেষকের কথাকে বিনা দলীল-
প্রমাণে চোখ বুজে গ্রহণ করা।
আল্লামা জুরজানী (রহঃ)-এর মতে,
‘তাক্বলীদ হ’ল বিনা দলীল-প্রমাণে অন্যের
কথা গ্রহণ করা’।
(জুরজানী, কিতাবুত তা’রীফাত, পৃঃ ৬৪।)
ইমাম শাওকানী (রহঃ)-এর মতে,
‘তাকলীদ হ’ল বিনা দলীলে অন্যের মত গ্রহণ
করা, যার মত দলীল হিসাবে সাব্যস্ত হবে না’।
(ইমাম শাওকানী, ইরশাদুস সায়েল
ইলা দালায়িলিল মাসায়েল, পৃঃ ৪০৮।)
‘তাফসীরে আযওয়াউল বায়ান’-এর লেখক
মুহাম্মাদ আল-আমীন আশ-শানক্বীত্বী (রহঃ)-এর
মতে,
‘তাক্বলীদ হ’ল কারো দলীল সম্পর্কে অবহিত
না হয়ে তার কথা গ্রহণ করা’।
(মুহাম্মাদ আল-আমীন আশ-শানক্বীত্বী,
মুযাক্কিরাতু উছূলিল ফিক্বহ, পৃঃ ৪৯০।)
তাক্বলীদের উপরোক্ত সংজ্ঞাগুলোর
আলোকে বলা যায় যে, শারঈ বিষয়ে কারো কোন
কথা বিনা দলীলে গ্রহণ করাই তাক্বলীদ।
পক্ষান্তরে দলীলসহ গ্রহণ করলে তা হয়
ইত্তেবা। আভিধানিক
অর্থে ইত্তেবা হচ্ছে পদাংক অনুসরণ করা।
পারিভাষিক অর্থে ‘শারঈ বিষয়ে কারো কোন
কথা দলীল সহ মেনে নেওয়া’।
তাক্বলীদের প্রকারভেদ :
তাক্বলীদ দু’প্রকার- জাতীয় তাক্বলীদ ও
বিজাতীয় তাক্বলীদ। জাতীয় তাক্বলীদ
বলতে ধর্মের নামে মুসলিম সমাজে প্রচলিত
বিভিন্ন মাযহাব ও তরীক্বার অন্ধ অনুসরণ বুঝায়।
বিজাতীয় তাক্বলীদ বলতে বৈষয়িক ব্যাপারের
নামে সমাজে প্রচলিত পুঁজিবাদ, সমাজবাদ,
গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ
প্রভৃতি বিজাতীয় মতবাদের অন্ধ অনুসরণ বুঝায়।
ইত্তেবা ও তাক্বলীদের
মধ্যে পার্থক্য :
আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হ’তে প্রেরিত অহী-র
বিধানের যথাযথ অনুসরণের নাম ইত্তেবা। এ
মর্মে আললাহ তা‘আলা বলেন,
‘তোমার নিকট এজন্য কিতাব (কুরআন) অবতীর্ণ
করা হয়েছে, তোমার অন্তরে যেন এর
সম্পর্কে কোন সংকোচ না থাকে এর
দ্বারা সতর্কীকরণের
ব্যাপারে এবং এটা মুমিনদের জন্য উপদেশ।
তোমাদের নিকট তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ
হ’তে যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তোমরা তার
অনুসরণ কর এবং তোমরা তাঁকে ছাড়া অন্য কোন
অলি-আউলিয়ার অনুসরণ করো না। তোমরা খুব
অল্পই উপদেশ গ্রহণ করে থাক’
(আ‘রাফ ৭/২-৩)।
তাকলীদ ও ইত্তেবা দু’টি ভিন্ন বিষয়। এদু’টির
মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।‘তাক্বলীদ’ হ’ল
নবী ব্যতীত অন্য কারো শারঈ
বক্তব্যকে বিনা দলীলে গ্রহণ করা।
পক্ষান্তরে ছহীহ দলীল অনুযায়ী নবীর অনুসরণ
করাকে বলা হয়‘ইত্তেবা’। একটি হ’ল দলীল
ব্যতীত অন্যের রায়ের অনুসরণ। আর অন্যটি হ’ল
দলীলের অর্থাৎ কুরআন ও সুন্নাহর অনুসরণ।
মূলতঃ ‘তাক্বলীদ’ হ’ল রায়ের অনুসরণ।
আর ‘ইত্তেবা’ হ’ল ‘রেওয়ায়াতে’র অনুসরণ।
যেমন ইমাম শাওকানী (রহঃ) বলেন,
‘তাক্বলীদ হ’ল রায়-এর অনুসরণ
এবং ‘ইত্তেবা’ হ’ল রেওয়ায়াতের অনুসরণ।
ইসলামী শরী‘আতে ‘ইত্তেবা’সিদ্ধ
এবং ‘তাক্বলীদ’ নিষিদ্ধ’।(শাওকানী, আল-
ক্বাওলুল মুফীদ
(মিসরী ছাপা ১৩৪০/১৯২১ খৃঃ), পৃঃ ১৪।)
মুহাম্মাদ আল-আমীন আশ-শানক্বীত্বী (রহঃ)
বলেন,
‘তাকলীদ হ’ল কারো দলীল সম্পর্কে অবহিত
না হয়ে তার কথা গ্রহণ করা, যা তার ইজতিহাদ
বা গবেষণা ব্যতীত কিছুই নয়। পক্ষান্তরে শারঈ
দলীল কারো মাযহাব ও কথা নয়;
বরং তা একমাত্র অহী-র বিধান, যার অনুসরণ
করা সকলের উপর ওয়াজিব’।
(ঐ।)
ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল (রহঃ) বলেন,
‘ইত্তেবা হ’ল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এবং তার
ছাহাবীগণ হ’তে যা কিছু এসেছে তা গ্রহণ করা’।
অতঃপর তিনি বলেন, ‘তোমরা আমার তাক্বলীদ
করো না এবং তাক্বলীদ করো না মালেক,
ছাওরী ও আওযা’ঈরও। বরং গ্রহণ কর
তারা যা হ’তে গ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ কুরআন ও
সুন্নাহ।
(ইবনুল কাইয়িম, ইলামুল মুওয়াক্কি’ঈন,
৩/৪৬৯পৃঃ।)
উল্লেখ্য যে, কোন আলেমের ছহীহ দলীল
ভিত্তিক কোন কথাকে মেনে নেওয়ার
নাম ‘তাক্বলীদ’ নয়, বরং তা হ’ল ‘ইত্তেবা’।
অনুরূপভাবে কোন আলেমের দেওয়া ফৎওয়ার
বিপরীতে কোন ছহীহ দলীল পাওয়া গেলে উক্ত
ফৎওয়া পরিত্যাগ করে ছহীহ দলীলের অনুসরণ
করাকে বলা হয় ‘ইত্তেবা’। ছাহাবায়ে কেরাম ও
তাবেঈনে ইযামের যুগে তাক্বলীদের কোন
অস্তিত্ব ছিল না। বরং তাঁদের দলীলভিত্তিক
কথার অনুসরণকে অনেকে ‘তাক্বলীদ’ বলে ভুল
বুঝিয়েছেন।
ইসলাম মানব জাতিকে আল্লাহ প্রেরিত সত্য
গ্রহণ ও তাঁর নবীর ইত্তেবা করতে আহবান
জানিয়েছে। কোন মানুষের ব্যক্তিগত রায়ের
অনুসরণ করতে কখনই বলেনি। কোন মানুষ যেহেতু
ভুলের ঊর্ধ্বে নয়, তাই মানবরচিত কোন মতবাদই
প্রকৃত সত্যের সন্ধান দিতে পারে না। সেই
মতবাদে পৃথিবীতে শান্তিও আসতে পারে না। আর
এজন্যই নবী ব্যতীত অন্যের তাক্বলীদ নিষিদ্ধ
এবং নবীর ইত্তেবা মানব জীবনের সকল
ক্ষেত্রে অপরিহার্য।
তাক্বলীদের ব্যাপারে চার ইমামের
নিষেধাজ্ঞা :
ইসলামের প্রসিদ্ধ চার ইমাম অর্থাৎ ইমাম আবু
হানীফা (রহঃ), ইমাম মালেক (রহঃ), ইমাম শাফেঈ
(রহঃ) এবং ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ)
তাঁরা প্রত্যেকেই বিরাট পন্ডিত, পরহেযগার
এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি আনুগত্যশীল
ছিলেন। দুনিয়ার বুকে পিওর
ইসলামকে টিকিয়ে রাখার জন্য
তাঁরা প্রাণপণে চেষ্টা করেছেন। চেষ্টা করেছেন
মানুষের সার্বিক জীবনকে কুরআন ও সুন্নাহ
অনুযায়ী গড়ে তোলার। কোন মাসআলার
ফায়ছালা কুরআন ও ছহীহ
হাদীছে না পেলে তাঁরা ইজতিহাদ
বা গবেষণা করে ফায়ছালা প্রদান করেছেন।
তাতে ভুল হ’লেও তাঁরা ছওয়াবের
অধিকারী হয়েছেন। এ ব্যাপারে হাদীছে এসেছে,
আমর ইবনুল আছ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি রাসূল
(ছাঃ)-কে এ কথা বলতে শুনেছেন,
‘কোন বিচারক ইজতিহাদে সঠিক
সিদ্ধান্তে পৌঁছলে তার জন্য
আছে দু’টি পুরস্কার। আর বিচারক ইজতিহাদে ভুল
করলে তার জন্যও রয়েছে একটি পুরস্কার’।
(বুখারী, হা/৭৩৫২ ‘কুরআন-
সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা’ অধ্যায়, ‘বিচারক
ইজতিহাদে ঠিক করুক বা ভুল করুক তার প্রতিদান
পাবে’ অনুচ্ছেদ।)
অত্র হাদীছের উপর ভিত্তি করেই ইমামগণ
ইজতিহাদ বা শরী’আত
গবেষণা করে মানুষকে সঠিক পথের দিশা দেওয়ার
চেষ্টা করেছেন। এই হাদীছ
না থাকলে হয়তবা তাঁরা ইজতিহাদ করতেন না।
কারণ তাঁরা ভয় করতেন যে, তাঁদের কথা কুরআন ও
সুন্নাহর বিরুদ্ধে যেতে পারে। এজন্য
তাঁরা তাঁদের তাক্বলীদ করতে কঠোরভাবে নিষেধ
করেছেন। যেমন-
১- ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর
নিষেধাজ্ঞা :
(ক) ‘যখন ছহীহ হাদীছ পাবে, জেনো সেটাই আমার
মাযহাব’। (হাশিয়াহ ইবনে আবেদীন ১/৬৩।)
(খ) ‘আমরা কোথা থেকে গ্রহণ করেছি,
তা না জেনে আমাদের কথা গ্রহণ করা কারো জন্য
বৈধ নয়’। (ঐ ৬/২৯৩।)
(গ) ‘যে ব্যক্তি আমার দলীল জানে না, আমার
কথা দ্বারা ফৎওয়া প্রদান করা তার জন্য
হারাম’। (ড. অছিউল্লাহ বিন মুহাম্মাদ আব্বাস,
আত-তাক্বলীদ ওয়া হুকমুহু ফী যুইল কিতাব
ওয়াস-সুন্নাহ, পৃঃ ২০।)
(ঘ) ‘নিশ্চয়ই আমরা মানুষ। আমরা আজকে যা বলি,
আগামীকাল তা থেকে ফিরে আসি’। (ঐ।)
(ঙ) ‘তোমার জন্য আফসোস হে ইয়াকুব (আবু
ইউসুফ)! তুমি আমার থেকে যা শোন তাই
লিখে নিও না। কারণ আমি আজ যে মত প্রদান
করি, কাল তা প্রত্যাখ্যান করি এবং কাল যে মত
প্রদান করি, পরশু তা প্রত্যাখ্যান করি’। (ঐ।)
(চ) ‘আমি যদি আল্লাহর কিতাব (কুরআন) ও
রাসূলুললাহ (ছাঃ)-এর কথার (হাদীছ)
বিরোধী কোন কথা বলে থাকি, তাহ’লে আমার
কথাকে ছুঁড়ে ফেলে দিও’। (ছালেহ ফুল্লানী,
ইক্বাযু হিমাম, পৃঃ ৫০।)
২- ইমাম মালেক (রহঃ)-এর
নিষেধাজ্ঞা :
(ক) ‘আমি একজন মানুষ মাত্র। আমি ভুল করি,
আবার ঠিকও করি। অতএব আমার
সিদ্ধান্তগুলো তোমরা যাচাই কর।
যেগুলো কুরআন ও সুন্নাহর
অনুকূলে হবে সেগুলো গ্রহণ কর। আর
যেগুলো কুরআন ও সুন্নাহর
প্রতিকূলে হবে তা প্রত্যাখ্যান কর’। (ইমাম ইবনু
হাযম, আল-ইহকাম ফী উছূলিল আহকাম, ৬/১৪৯।)
(খ) ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পরে এমন কোন
ব্যক্তি নেই, যার সকল কথাই গ্রহণীয়
বা বর্জনীয়, একমাত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ব্যতীত’।
(ঐ ৬/১৪৫।)
৩- ইমাম শাফেঈ (রহঃ)-এর
নিষেধাজ্ঞা :
(ক) ‘যদি তোমরা আমার বইয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর
সুন্নাহ বিরোধী কিছু পাও, তাহ’লে রাসূল (ছাঃ)-
এর সুন্নাহ অনুযায়ী বল এবং আমার
কথাকে প্রত্যাখ্যান কর’। অন্য এক বর্ণনায়
এসেছে, ‘তোমরা রাসূল (ছাঃ)-এর কথারই অনুসরণ
কর এবং অন্য কারো কথার দিকে দৃকপাত কর না’।
(ইমাম নববী, আল-মাজমূ, ১/৬৩।)
(খ) ‘আমি যেসব কথা বলেছি, তা যদি রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ)-এর ছহীহ হাদীছের বিপরীত হয়, তবে রাসূল
(ছাঃ)-এর হাদীছই অগ্রগণ্য। অতএব
তোমরা আমার তাক্বলীদ কর না’। (ইবনু
আবী হাতেম, পৃঃ ৯৩, সনদ ছহীহ।)
(গ) ‘রাসূলুললাহ (ছাঃ)-এর প্রত্যেকটি হাদীছই
আমার কথা, যদিও আমার নিকট
থেকে তোমরা তা না শুনে থাক’। (ঐ।)
৪- ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ)-
এর নিষেধাজ্ঞা :
(ক) ‘তুমি আমার তাক্বলীদ কর না এবং তাক্বলীদ
কর না মালেক, শাফেঈ, আওযাঈ ও ছাওরীর।
বরং তাঁরা যে উৎস হ’তে গ্রহণ করেছেন, সেখান
থেকে তোমরাও গ্রহণ কর’। (ইলামুল
মুওয়াক্কি’ঈন, ২/৩০২।)
(খ) ‘যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর
হাদীছকে প্রত্যাখ্যান করল, সে ধ্বংসের
দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেল’। (নাছিরুদ্দীন আলবানী,
মুকাদ্দামাতু ছিফাতি ছালাতিন নাবী (ছাঃ),
পৃঃ ৪৬-৫৩।)
তাক্বলীদের উৎপত্তি :
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এবং ছাহাবীদের
যুগে তাক্বলীদ অর্থাৎ কেউ
কারো কথা বিনা দলীলে গ্রহণ করতেন না। কুরআন
ও হাদীছের মধ্যেও ‘তাক্বলীদ’শব্দের অস্তিত্ব
খুঁজে পাওয়া যায় না। বিভিন্ন আয়াত ও
হাদীছে অর্থগতভাবে তাক্বলীদ
সম্পর্কে যা এসেছে তাও খারাপ অর্থে, ভাল
অর্থে নয়।
সর্বপ্রথম ‘তাক্বলীদ’ শব্দের
উৎপত্তি হয়েছে ছাহাবীদের যুগে। ঐ
শব্দটি ব্যবহার করে শরী’আতের যাবতীয়
বিষয়ে কারো তাক্বলীদ তথা অন্ধ অনুসরণ
করতে নিষেধ করা হয়েছে। যেমন আব্দুললাহ ইবনু
মাস’উদ (রাঃ) বলেন, ‘সাবধান! তোমাদের কেউ
যেন ঐ ব্যক্তির ন্যায় দ্বীনের
ব্যাপারে কারো তাক্বলীদ না করে, যে (যার
তাক্বলীদ করা হয়) ঈমানদার
হ’লে সে (মুক্বাল্লিদ) ঈমানদার হয়, আর কাফের
হ’লে সেও কাফের হয়। কেননা মন্দ
বা খারাপে কোন আদর্শ নেই’। (ইবনু আব্দিল
বার্র, জামেউ বায়ানিল
ইলমি ওয়া ফাযলিহি ২/৯৮৮।)
বলা হয়ে থাকে, যাদের শরী’আত সম্পর্কে জ্ঞান
নেই তাদের উপর তাক্বলীদ করা ওয়াজিব। এই
কথাটিও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীদের
যুগে কারো জানা ছিল না। বরং তাঁরা ইসলামের
যাবতীয় বিধান দলীলভিত্তিক পালনের
মাধ্যমে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের
ইত্তেবা বা অনুসরণ করেছেন, তাক্বলীদ করেননি।
কারণ সাধারণ মানুষ- যাদের শরী’আত
সম্পর্কে জ্ঞান নেই, তারাও শুধুমাত্র একজনের
ফৎওয়া গ্রহণ করতেন না। বরং স্থান, কাল ও
পাত্রভেদে বিভিন্ন সময় বিভিন্নজনের নিকট যুগ-
জিজ্ঞাসার জবাব নিতেন। আর
যারা ফৎওয়া প্রদান করতেন তাঁদের মূল
ভিত্তি ছিল কুরআন ও ছহীহ হাদীছ। তৎকালীন
যুগে কোন মাযহাব ও নির্দিষ্ট ফিক্বহের কিতাব
ছিল না। সুতরাং তাঁরা কারো অন্ধানুসারী ছিলেন
না। যদি কারো মধ্যে তাক্বলীদ প্রকাশ পেত,
অথবা কারো কোন কথা রাসূলুললাহ (ছাঃ)-এর
কথার বিপরীত হ’ত তাহ’লে অন্যান্য ছাহাবীগণ
তার তীব্র প্রতিবাদ করতেন। যেমন-
১. ইমরান ইবনু হুছাইন (রাঃ) হ’তে বর্ণিত,
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
‘লজ্জাশীলতা কল্যাণ বৈ কিছুই আনয়ন করে না’।
তখন বুশায়র ইবনু কা’ব (রাঃ) বললেন, হিকমতের
পুস্তকে লিখা আছে যে, কোন কোন
লজ্জাশীলতা ধৈর্যশীলতা বয়ে আনে। আর কোন
কোন লজ্জাশীলতা এনে দেয় শান্তি ও সুখ। তখন
ইমরান (রাঃ) বললেন, আমি তোমার
কাছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে (হাদীছ)
বর্ণনা করছি। আর তুমি কিনা (তদস্থলে)
আমাকে তোমার পুস্তিকা থেকে বর্ণনা করছ?
(বুখারী,
হা/৬১১৭ ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায়,‘লজ্জাশীলতা’ অনুচ্ছেদ।)
২.
আব্দুললাহ ইবনু মুগাফফাল (রাঃ) হ’তে বর্ণিত,
তিনি এক ব্যক্তিকে দেখলেন, সে ছোট ছোট
পাথর নিক্ষেপ করছে। তখন তিনি তাকে বললেন,
পাথর নিক্ষেপ কর না। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)
পাথর ছুঁড়তে নিষেধ করেছেন
অথবা বর্ণনাকারী বলেছেন, পাথর
ছোঁড়াকে তিনি অপসন্দ করতেন। নবী করীম (ছাঃ)
বলেছেন, এর দ্বারা কোন প্রাণী শিকার করা যায়
না এবং কোন শত্রুকেও ঘায়েল করা যায় না।
তবে এটা কারো দাঁত
ভেঙ্গে ফেলতে পারে এবং চোখ
উপরিয়ে দিতে পারে। অতঃপর তিনি আবার
তাকে পাথর ছুঁড়তে দেখলেন। তখন তিনি বললেন,
আমি তোমাকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর হাদীছ
বর্ণনা করছিলাম যে, তিনি পাথর নিক্ষেপ
করতে নিষেধ করেছেন অথবা তিনি তা অপসন্দ
করেছেন। অথচ (একথা শুনেও) তুমি পাথর
নিক্ষেপ করছ? আমি তোমার সঙ্গে কথাই বলব
না এতকাল এতকাল পর্যন্ত।
(বুখারী, হা/৫৪৭৯ ‘যবেহ ও শিকার’ অধ্যায়, ছোট
ছোট পাথর নিক্ষেপ করা ও বন্দুক
মারা’ অনুচ্ছেদ।)
৩.
ইবনু শিহাব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, সালেম ইবনু
আব্দুল্লাহ (রাঃ) তাকে (ইবনে শিহাব) বলেছেন,
তিনি [সালেম ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ)] শামের
একজন লোকের নিকট থেকে শুনেছেন,
তিনি আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ)-
কে হজ্জে তামাত্তু সম্পর্কে জিজ্ঞেস
করলে আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) বললেন,
তা হালাল। তখন সিরীয় লোকটি বললেন, তোমার
পিতা (ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব) তা নিষেধ করেছেন।
তখন আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) বললেন, যে কাজ
আমার পিতা নিষেধ করেছেন সে কাজ
যদি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পালন করেন,
তাহ’লে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নির্দেশ
অনুসরণযোগ্য, না আমার বাবার নির্দেশ
অনুসরণযোগ্য? লোকটি বললেন, বরং রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ)-এর নির্দেশ অনুসরণযোগ্য। তখন
আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) বললেন, রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ) হজ্জে তামাত্তু আদায় করেছেন।
(তিরমিযী,
হা/৮২৪, ‘হজ্জ’ অধ্যায়, ‘হজ্জে তামাত্তু
সম্পর্কে যা এসেছে’ অনুচ্ছেদ, সনদ ছহীহ।)
২য় শতাব্দী হিজরীর পরে প্রচলিত তাক্বলীদের
আবির্ভাব ঘটে। অতঃপর ৪র্থ
শতাব্দী হিজরীতে বিভিন্ন ইমামের নামে বিভিন্ন
তাক্বলীদী মাযহাবের প্রচলন হয়। শাহ
অলিউল্লাহ দেহলভী (রহঃ) বলেন, ‘জেনে রাখ,
চতুর্থ শতাব্দী হিজরীর আগের লোকেরা নির্দিষ্ট
কোন একজন বিদ্বানের মাযহাবের মুক্বাল্লিদ
তথা অন্ধানুসারী ছিল না। কোন
সমস্যা সৃষ্টি হ’লে লোকেরা যেকোন আলেমের
নিকট থেকে ফৎওয়া জেনে নিত। এ
ব্যাপারে কারো মাযহাব যাচাই করা হ’ত না’। (শাহ
অলিউল্লাহ, হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগাহ
১/১৫২-৫৩‘চতুর্থ শতাব্দী ও তার পরের লোকদের
অবস্থা বর্ণনা’ অনুচ্ছেদ।)
এই উক্তি প্রমাণ করে যে, মাযহাবের তাক্বলীদ
শুরু হয়েছে ৪র্থ শতাব্দী হিজরী হ’তে।
ওলামায়ে কেরাম-যাদের ইজতিহাদ সর্বত্র গৃহীত
হয়েছে, তাঁরা সকলেই তাক্বলীদের
বিরোধিতা করেছেন। যেমন- ইবনুল কাইয়িম (রহঃ)
বলেন,‘নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তির তাক্বলীদ
দ্বারা ফৎওয়া প্রদান করা জায়েয নয়।
কেননা তাক্বলীদ ইলম নয়। আর ইলমবিহীন
ফৎওয়া প্রদান করা হারাম। সকলের ঐক্যমত হ’ল
তাক্বলীদের নাম ইলম নয় এবং মক্বাল্লিদের নাম
আলেম নয়। ( ই’লামুল মুওয়াক্কি’ঈন, ২/৮৬।)
অতএব তাক্বলীদ নয়, কুরআন ও হাদীছের যথাযথ
অনুসরণই ইসলামের মৌলিক বিষয়।
যেমনটি অনুসরণ করেছেন সালাফে ছালেহীন।
তারা কারো মুক্বাল্লিদ ছিলেন না।
প্রসিদ্ধ চার ইমামের সাথে তাঁদের ছাত্রদের
অনেক মাসআলায় মতবিরোধ লক্ষ্য করা যায়।
‘মুখতাছারুত ত্বহাবী’ গ্রন্থে অনেক
মাসআলাতে ইমাম আবু হানীফার মতের বৈপরীত্য
পরিলক্ষিত হয়। অনুরূপভাবে ‘হেদায়াহ’গ্রন্থ
প্রণেতা মারগিনানী, ‘বাদায়েয়ুছ
ছানায়ে’ প্রণেতা আল-কাসানী,‘ফাতহুল
ক্বাদীর’ প্রণেতা কামাল ইবনুল হুমাম প্রমুখ
আলেম হানাফী মাযহাবের বড় বড় বিদ্বান
ছিলেন। কিন্তু তাঁরা ইমাম আবু হানীফার
অন্ধানুসারী ছিলেন না; বরং কুরআন ও হাদীছ
অনুসরণ করতে গিয়ে ইমাম আবু হানীফার অনেক
মতকে তারা প্রত্যাখ্যান করেছেন।
প্রকৃতপক্ষে তাঁরাই ইমাম আবু হানীফার
অনুসারী ছিলেন। কেননা তিনি বলেন,
‘যখন ছহীহ হাদীছ পাবে, জেনো সেটাই আমার
মাযহাব’।
অনুরূপভাবে ইবনু কুদামা (রহঃ), শায়খুল ইসলাম
ইমাম ইবনু তায়মিয়া (রহঃ), ইবনুল ক্বাইয়িম
(রহঃ), ইবনু রজব (রহঃ) হাম্বলী মাযহাবের
খ্যাতনামা বিদ্বান ছিলেন। আবু ইসহাক আশ-
শীরাযী (রহঃ), ইমাম নববী (রহঃ) শাফেঈ
মাযহাবের এবং ইবনু আব্দিল বার্র (রহঃ), ইবনু
রুশদ (রহঃ), ইমাম শাত্বেবী (রহঃ)
মালেকী মাযহাবের বিদ্বান ছিলেন। তাঁদের কেউ
কোন নির্দিষ্ট মাযহাবের অন্ধানুসারী ছিলেন
না। বরং তাঁরা কুরআন ও ছহীহ হাদীছের অনুসরণ
করতে গিয়ে তাঁদের ইমামদের বিরুদ্ধে মত পোষণ
করতে সামান্যতম দ্বিধাবোধ করেননি।p

Categories: Uncategorized | এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

পোস্টের নেভিগেশন

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

Create a free website or blog at WordPress.com.